শনিবার এই ঐতিহাসিক জয়ের পর দফায় দফায় সাফল্য উদযাপন করেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট তারকারা। কাপ হাতে তোলার সময় এক দফা, ড্রেসিংরুমে ঢুকে আর এক দফা এবং হোটেলে ফিরে আরও এক দফা সেলিব্রেশন করেন তাঁরা। টানা আট মাস ধরে লিগের ২৪টি ম্যাচ খেলেছে তারা। তারও আগে প্রায় তিন মাস ধরে প্রাক মরশুম প্রস্তুতি ও প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছেন। খেলেছেন ডুরান্ড কাপ। সারা মরশুমের এই তুমুল পরিশ্রমে কোনও ফাঁকি ছিল না বলেই অবশেষে এই সাফল্য পেয়েছে তারা। সামনে যদিও সুপার কাপ রয়েছে। কিন্তু আইএসএলে জোড়া খেতাব জয়ের আনন্দই আলাদা।
যে স্তরের ফুটবল খেলে সাফল্য পেয়েছে তারা, যে মানের দলগুলিকে হারিয়ে ক্রমশ শিল্ড ও কাপ জয়ের দিকে এগিয়েছে তারা, তা এক কথায় অনবদ্য। প্রথমত, দুর্দান্ত দল ও যোগ্য কোচ বাছাই করেছে তারা। তার পরে সেই দল নিয়ে প্রতি ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখানো, দলের মধ্যে ভাল বোঝাপড়া তৈরি করা—এ সবই তারা ঠিকমতো করতে পেরেছে বলেই এমন বেনজির সাফল্য পেয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ এই ক্লাব।
শনিবার ম্যাচের পর মোহনবাগান সুপর জায়ান্টের অধিনায়ক শুভাশিস বসু মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে বলেন, “এটা আমার একার কৃতিত্ব নয়, গোটা দল নিজেদের সবকিছু দিয়েছে বলেই আমরা ট্রফি জিততে পেরেছি এবং টানা দু’বার শিল্ড জয় করতে পেরেছি। আমাদের পারফরম্যান্স আর মনোভাব নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টসের অধিনায়ক হিসেবে জেতা আমার জন্য খুবই বিশেষ। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল মোহনবাগানের হয়ে খেলব, আর আজ আমি গর্বিত যে আমি এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি।
আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হল দলের বন্ধন ও পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া। কোচ খুব ভালভাবে ড্রেসিং রুম সামলেছেন, আমিও চেষ্টা করেছি ড্রেসিংরুমে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখতে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের অবদান, তাদের মনোভাব—মাঠে এবং মাঠের বাইরে—এই সাফল্য অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই মরশুমে অধিনায়ক হিসেবে শিল্ড এবং কাপ জয় আমার কাছে অত্যন্ত বিশেষ এবং স্মরণীয়”।
শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে নির্ধারিত সময়ে ফল ১-১ থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে জয়সূচক গোল করে লিগের ইতিহাসে এই প্রথম দ্বিমুকুট জেতে হোসে মোলিনার দল। দেড় মাস আগেই লিগশিল্ড জিতে নিয়েছিল তারা। এ বার কাপও জিতে নেয় তারা। ফলে ভারতীয় ফুটবলে তৈরি হয় এক নতুন ঐতিহাসিক মাইলফলক।
প্রথমার্ধে বেঙ্গালুরু এফসি আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় ফিরে আসে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ৪৯ মিনিটের মাথায় আলবার্তো রড্রিগেজের নিজগোলে এগিয়ে যায় বেঙ্গালুরু এফসি। ৭২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে সেই গোল শোধ করেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর অস্ট্রেলিয়ান তারকা জেসন কামিংস। অতিরিক্ত সময়ে ছ’মিনিটের মাথায় আর এক অজি তারকা জেমি ম্যাকলারেনের (Jamie Maclaren) গোলে শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক খেতাব জেতে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব।
জয়ের নায়ক ম্যাকলারেন স্টেডিয়াম থেকে হোটেলের দিকে রওনা হওয়ার আগে বলেন, “এটা একটা অসাধারণ অনুভূতি। আমরা বলেছিলাম আমরা এটা করব এবং আমরা করে দেখিয়েছি। এখন আমরা শুধু এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চাই”।
ফাইনালের লড়াই সম্পর্কে ম্যাকলারেন বলেন, “বেঙ্গালুরু একটা দুর্দান্ত দল। ওদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। ওরাও দারুণ একটা মরশুম কাটিয়েছে। খুব ভালো ফুটবল খেলেছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের চ্যালেঞ্জ করেছিল। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছিলাম, সেটাই বলতে পারি। আমরা জানতাম ম্যাচটা আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। কিন্তু নিজেদের মাঠে আমরা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠি এবং আমাদের সমর্থকেরা বরাবরের মতোই আমাদের পাশে ছিল, ওরাই আমাদের জয় এনে দিয়েছে”।
এ দিন ফাইনালে যুবভারতীর গ্যালারিতে প্রায় ৫৯ হাজার দর্শক ছিল। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের প্রতিটি গোলমুখী আক্রমণ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়েছে তারা। এমনকী তাদের শহরের প্রিয় জামাই সুনীল ছেত্রী ও তাঁর সতীর্থরা আক্রমণে উঠলে বা গোল করলেও কম উল্লাস হয়নি। যে দলই ভাল ফুটবল খেলুক, কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরা যে তাদের পাশে থাকেনই, তা এ দিন বুঝে নেয় বেঙ্গালুরুর ফুটবলাররা।
অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ালেও তারা ধৈর্য ধরে বসে ছিল, কখন তাদের প্রিয় দল গোল করে নতুন ইতিহাস গড়বে। ম্যাকলারেনও অপেক্ষা করছিলেন, কখন সুযোগ আসবে ও তা কাজে লাগাতে পারবেন তিনি। সেই সুযোগ আসে অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে, ৯৬ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের বক্সের ডানদিকের কোণ থেকে বক্সের মাঝখানে বল বাড়ান স্টুয়ার্ট। সেই বল পেয়ে প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গোলে শট নেন ম্যাকলারেন। এবার আর তাঁর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তাঁর এই গোলের সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাসে ফেটে পড়ে যুবভারতীর ফুটবলপ্রেমী জনতা ও তখনই মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যে সেলিব্রেশন শুরু হয়ে যায়।
তাঁর সেই স্মরণীয় গোল সম্পর্কে ম্যাকলারেন বলেন, “আমি জানতাম আমি গোল করব। তবে আমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়, কয়েকটা সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সেগুলো কাজে লাগাতে না পারা সত্ত্বেও কোচ আমাকে মাঠে রেখেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। গোল করে দলকে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন এবং আমি তার আস্থার প্রতি সুবিচার করতে পেরেছি। মোহনবাগানের হয়ে এই গোলটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়”।
শনিবার ফাইনাল খেলার পরেই মোহনবাগান শিবিরের একাধিক বিদেশী খেলোয়াড়রা যে যাঁর দেশে ফিরে গিয়েছেন বলে কলকাতার সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে এখানেই তাদের মরশুম পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে মরশুমের শেষ টুর্নামেন্ট কলিঙ্গ সুপার লিগ। ভুবনেশ্বরে এই টুর্নামেন্টে মোহনবাগান প্রথম মাঠে নামবে ২০ এপ্রিল। ১৬ দলের রাউন্ডের এই ম্যাচে জিতলে কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের মুখোমুখি হতে পারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল এফসি। এই নক আউট টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল ৩০ এপ্রিল ও ফাইনাল হওয়ার কথা ৩ এপ্রিল। অর্থাৎ, তারা ফাইনালে উঠলে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে আরও চারটি ম্যাচ খেলতে হবে।