স্বরূপ দত্ত
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। প্রয়াত হয়েছেন আজ থেকে ৬১ বছর আগে। কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটা কথা, প্রত্যেকটা সূত্র আজও জট খুলে দেয় জটিল আধুনিক পৃথিবীটার। ভাবছেন, শুরুতেই আইনস্টাইনের এত মালা জপতে বসলাম কেন? কারণ, আইনস্টাইনের কথাগুলো যে আমাদের জীবনে বড্ড প্রাসঙ্গিক। এডুকেশন সিস্টেম নিয়ে আইনস্টাইন নানা সময়ে সরব হয়েছেন। তাঁর একটি উক্তি তো কার্টুন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যেখানে আইনস্টাইন বলতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের এডুকেশন সিস্টেম ঠিক কতটা খারাপ। বলে, তিনি উদাহরণ দিয়েছিলেন, একবার বনের পশু পাখিদের ডেকে আনা হল। তারপর শিক্ষক তাদের প্রতিভা যাচাই করার জন্য সমান প্রশ্নের ব্যবস্থা করলেন। তাতে নাকি কারও উপর আর অবিচার হবে না। এর থেকে ‘ফেয়ার’ পরীক্ষা আবার হয় নাকি! এবার আপনিই বুঝুন, তা বলে কী আর জলের মাছ গাছে উঠবে নাকি!
আইনস্টাইনের এই কথাগুলো মনে পড়ল, সচিন তেন্ডুলকর আর দীপা কর্মকারের গাড়ি কর্মকাণ্ডে! অলিম্পিকে পদক না জিতলেও দেশকে গর্বিত করেছিলেন দীপা কর্মকার। চতুর্থস্থানে শেষ করে পদক হয়তো পাননি তিনি। কিন্তু দেশের তথা বিদেশের মানুষের মনটাই জিতে নিয়েছেন তিনি। দীপার এমন পারফরম্যান্সে গর্বিত হয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরও। নিজে ক্রীড়াবিদ। আরেকজন ক্রীড়াবিদের মর্ম তো বোঝেনই। তাই রিও থেকে ফেরার পরই দীপা কর্মকারের হাতে বিএমডব্লু গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছিলেন তিনি। একে উপহার সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের হাত থেকে পাওয়া। তার উপর সেটা নাকি আবার বিএমডব্লু গাড়ি! চওড়া হাসি দিয়ে সেই উপহার সাদরে গ্রহণ করেছিলেন দীপা। আর কৃতীকে উপহার দিতে পেরে গর্বিত হয়েছিলেন সচিনও!
কিন্তু গল্পটা যে এত সহজ নয়। দীপার ত্রিপুরার আগরতলার রাস্তাঘাট তো আর গ্রেটার নয়ডা নয়। কিংবা মুম্বই কিংবা দিল্লিও নয়। বরং, সেখানে সাইকেল, রিক্সা, অটো, টোটোতেই বেশি সওয়ার হন যাত্রীরা, সেখানে আবার বিএমডব্লু! দীপা সে গাড়ি রাখবেনই বা কোথায়! আর চালাবেনই বা কোথায়! তাই দীপা চাইছেন, ওই গাড়িটা ফিরিয়ে দিতে! কারণ, তাঁর কাছে বিএমডব্লু অন্তত এই মুহূর্তে খানিকটা ঝামেলাই। তিনি বিএমডব্লু গাড়ির বিলাস উপভোগ করার মতো পরিস্থিতিতেই নেই। তাঁর যে বুকে অনেক আগুন, চোখে অনেক স্বপ্ন। রিও অতীত। চার বছর পর টোকিও আসবে। সেখানে যে আর চতুর্থ হয়ে থেমে থাকতে চান না এই জিমন্যাস্ট!
মোদ্দা কথা সচিন আর দীপার এই উপহার চালাচালিতে একটা কথা মনে হল। আসলে উপহার দেওয়াটা একটা শিল্প। জরুরি এটা নয় যে, উপহারটা কে দিচ্ছেন। অনেক বেশি প্রয়োজনের উপহারটা কাকে দেওয়া হচ্ছে। এটা মাথায় থাকলে সুবিধা দুই পক্ষের। উপহারের দাম, দাম দিয়ে আবার নির্ধারণ করা যায় নাকি! তাই, যাঁকে উপহার দেওয়া হচ্ছে, সেই উপহারটা তাঁর কাছে কী আদৌ কাজের হবে? ভাবা উচিত তো সেটাও। সেই শেয়াল আর বকের গল্প মনে নেই ছেলেবেলার? যেখানে বককে থালায় করে স্যুপ খেতে দিয়েছিল শেয়াল। পাল্টা দিতে শেয়ালকেও কুঁজোর মধ্যে স্যুপ খেতে দিয়েছিল বকও!
না, সচিন আর দীপার সম্পর্কটা অন্তত শেয়াল আর বকের মতো নয়। তাঁদের দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্মান বোঝা যায়। কিন্তু সচিন যদি একটু ভাবনা চিন্তা করে উপহারটা দিতেন তাহলে দীপাকে বিপাকে পড়তে হতো না হয়তো! সচিনের উপহার ফেরানোর কথাও যে বলা যায় না দ্বিধা ছাড়া। আবার সেটা উপভোগও করা যাচ্ছে না! সচিন আসলে ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেটটা এত খেলেছেন যে, বাকিগুলো বোধহয় বিশেষ সময় দিয়ে জানা হয়নি। খুব স্বাভাবিক। না হলে বিএমডব্লু না দিয়ে, সচিন, দীপাকেই জিজ্ঞেস করতে পারতেন, ”তোমার জন্য সেরা উপহার দিতে চাই। বলো তুমি কী নেবে।” এতে যদি প্রথমবার দীপা ইতস্তত করতেন, তাহলে সচিনই বলতে পারতেন, ‘তোমার পছন্দের জিনিস নাও। নাহলে আমি ঠিক করেছি তোমায় বিএমডব্লু দেব।’ সেক্ষেত্রে দীপা হয়তো তাঁর কাছে অনেক বেশি জরুরি জিনিস সচিনের থেকে উপহার পেতেন। আর সেই উপহার হয়ে উঠতো, সেরা মানুষের থেকে পাওয়া দীপার জন্য সেরা উপহার। যা হয়তো সত্যিই আগামিদিনে দীপাকে সেরার শিরোপা জেতাতো।
সচিন এবার হয়তো আইনস্টাইনের কথা বুঝে গেলেন। – সবার জন্য এক প্রশ্নও যেমন ঠিক না, সবার জন্য এক উপহারও ঠিক না! সিন্ধুর চলার পথ তুলনায় মসৃণ। সেখানে বিএমডব্লু ছুটতে পারে। কিন্তু দীপার চলার পথের রাস্তা অনেক বেশি এবড়ো খেবড়ো। সেখানে দরকার অন্য কিছু। সচিন আর দীপা কতটা কী শিখলেন এই উপহারের বিষয়, তা তাঁরাই জানুন। কিন্তু আমার আপনার জন্য এই ঘটনাটা শিক্ষনীয় হয়ে থাকল বইকি! কারণ, এই ভুল তো আমরাও প্রতিনিয়ত করি। এবার থেকে আপনারাও, আমিও উপহারটা দেওয়ার আগে ভাববো আরও দুবার, কাকে সেটা দেওয়া হচ্ছে। আর তার জন্য সবথেকে ভালো উপহার কী হতে পারে। তবেই উপহার তার দাম পাবে।
(হেডলাইনে ‘ভুল’ শব্দটা লিখলাম, কারণ মনে হল উপহারটা নিয়ে যখন যিনি পেয়েছেন, তিনি খুশি নন, তাহলে ভুল একটা হয়েছে। আর এই লেখা একেবারে আমার ব্যক্তিগত মতামত। এই ভাবনার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা ডট কমের ভাবনাও এক হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।)
আরও পড়ুন খারাপ ক্যাপ্টেনরা কীভাবে কত প্রতিভাবান মানুষের জীবনটা নষ্ট করে দেয়