জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: সন্ন্যাসী কিন্তু ভূপর্যটকও তিনি। ছোট্ট জীবন জুড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন। এত সীমিত এক জীবনকালে এত সুবিপুল কাজ করে, এত বক্তৃতাদান, লেখালিখি, এত বহুমুখিনতার সঙ্গে জীবনযাপন করেও তিনি যে কী ভাবে এত বিশাল অঞ্চল ঘুরতে পারলেন সে-ও এক বিস্ময়। স্বামী বিবেকানন্দ। এহেন মানুষটি গিয়েছিলেন বাংলাদেশেও। তবে তখন তা ‘বাংলাদেশ’ নয়, তা অখণ্ড বাংলা। সেই বাংলারই এক বিখ্যাত শহরে তিনি গিয়েছিলেন। তাঁর সেই স্মরণীয় যাত্রার ১২৫ বছর পূর্ণ হল!
Zee ২৪ ঘণ্টার সব খবরের আপডেটে চোখ রাখুন। ফলো করুন Google News
বিবেকানন্দের কিন্তু দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গ বা ঢাকায় আসা হয়নি। যদিও তিনি ঢাকায় আসার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন বারবার। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য সাধু নাগমহাশয়ের কাছে তিনি এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতও ছিলেন, নাগ মহাশয়ের জন্মভূমি ঢাকায় যাবেন, বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ওপার বাংলায় স্বামীজি গেলেন যখন, তখন নাগ মহাশয় আর জীবিত নেই।
যাই হোক, তবু স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন পুর্ববঙ্গে, ঢাকায়। তাঁর ঢাকায় যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল মাকে ঢাকেশ্বরী তীর্থ দর্শন করানো। অতএব মা এসেছিলেন। আর আসেন স্বামীজির বোন। ১৯০১ সালের ১৮ মার্চ বেলুড় মঠ থেকে ন’জন রামকৃষ্ণভক্ত-সহ যাত্রা শুরু করেন স্বামীজি। পরদিন সকালে গোয়ালন্দ পৌঁছন। সেখান থেকে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকা। স্বামীজি তখন সারা দেশেই জনপ্রিয় বিখ্যাত নন্দিত এক পুরুষ। তাই তাঁর ঢাকা-আগমন জনমানসে বিশাল সাড়া পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঢাকার বিখ্যাত জমিদার মোহিনীমোহন দাসের ফরাসগঞ্জের বাড়িতে সপ্তাহদুয়েক ছিলেন।
ঢাকায় স্বামীজির আগমন ও এখানে তাঁর এই দুই সপ্তাহের মতো অবস্থান নিয়ে নানা জনের নানা লেখা রয়েছে। রয়েছে মন্মথ গাঙ্গুলির স্মৃতিকথা, আইনজীবী সতীশচন্দ্র রায়ের লেখা, বিপ্লবী বীর ও পরবর্তীকালে ‘অনুশীলন সমিতি’র হোতা হেমচন্দ্র ঘোষের বর্ণনা। আর রয়েছে তৎকালীন ‘ঢাকাপ্রকাশ’ পত্রিকায় স্বামীজি-সংক্রান্ত খবরাখবর। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের মঠাধ্যক্ষ স্বামী সম্পূর্ণানন্দজি হেমচন্দ্র ঘোষের এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানেও স্বামীজির ঢাকায় অবস্থানের দিনগুলির কথা বিশদভাবে উঠে এসেছে। এই সবগুলি থেকে স্বামীজির ঢাকা-বাসের একটা পরিপূর্ণ ছবি উঠে আসে।
কী রকম সে ছবি?
গোয়ালন্দ থেকে পদ্মা দেখতে দেখতে ঢাকায় যাওয়া স্বামীজির। মন্মথ গাঙ্গুলির স্মৃতিকথা বলছে, ১ টাকা দিয়ে ১৬টি ইলিশ মাছ কেনা হল। নিকটস্থ গ্রাম থেকে জোগাড় করা হল চাল আর পুঁইশাক। তারপর সঙ্গের সকলকে এবং মাঝিমাল্লা ও খালাসি-সহ তিনি আহার করলেন তা।
আরও পড়ুন: Ram Navami 2025 Zodiac: এই রামনবমীতে কোন কোন রাশির জাতকেরা তুমুল সাফল্যের মুখ দেখবেন, হাতে আসবে বিপুল টাকা?
আরও পড়ুন: Nine Months in Space: মাসের পর মাস মহাকাশে থাকলে হতে পারে ক্যানসার, আসতে পারে অন্ধত্ব! সুনীতাদেরও কি হতে পারে এই…
এ তো আসর পথের ছবি। আর ঢাকায় পৌঁছনোর পরে?
স্বামীজি ঢাকায় পৌঁছতে তাকে সংবর্ধনা দেন আইনজীবী ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও গণেশচন্দ্র ঘোষ। নারায়ণগঞ্জে তাঁকে সংবর্ধনা দেয় ‘ঢাকা অভ্যর্থনা সমিতি’। স্বামীজিকে দেখতে, তাঁর সঙ্গ পেতে প্রতিদিনই বহু মানুষ আসতেন ঢাকার জমিদারবাড়িতে। এঁদের মধ্যে হেমচন্দ্র ঘোষ ও দেবেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন অন্যতম। দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধে স্বামীজি তাঁকে গানও শুনিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ তিনি মাকে নিয়ে যান লাঙ্গলবন্দ। ঢাকার অদূরে ব্রহ্মপুত্রের পারে এটি হিন্দুদের একটি বিশেষ তীর্থক্ষেত্র। কথিত আছে, মাতৃহত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দশ অবতারের অন্যতম পরশুরাম এখানে স্নান করে শুদ্ধ ও পাপমুক্ত হন। স্বামীজির ঢাকা আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অদূরে দেবভোগ গ্রামে সাধু নাগমহাশয়ের বাড়ি যাওয়া। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য ছিলেন দুর্গাচরণ নাগ। গিয়েছিলেন সেখানেও। সেখান থেকে ফেরার সময়ে নাগ মহাশয়ের স্ত্রী তাঁকে একটি কাপড় উপহার দেন। ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি বিবেকানন্দ। সম্ভবত শারীরিক অসুস্থতাই এর কারণ। ৩০ মার্চ রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন তিনি। পর দিন ৩১ মার্চে বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে।
ঢাকা-পর্ব শেষ করে স্বামীজি ১ এপ্রিল ট্রেন-যোগে চট্টগ্রাম যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য, মা ভুবনেশ্বরীকে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শন করানো। সীতাকুণ্ডে উপস্থিত হয়ে তিনি অতিথি হন জমিদার রায়বাহাদুর হরকিশোর রায়চৌধুরীর গৃহে।
স্বামীজি ঢাকার মানুষজনকে তীক্ষভাবে অবলোকন করেছিলেন। এর প্রমাণ মেলে ‘স্বামিশিষ্যসংবাদ’-এ বর্ণিত তাঁর কথা থেকে। এই বইটির লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর দেশ পূর্ববঙ্গ। তাই তিনি স্বভাবতই জানতে চেয়েছিলেন, ঢাকার মানুষদের ঠিক কেমন দেখলেন স্বামীজি? স্বামীজির উত্তর ছিল, ‘আমাদের এদিকের চেয়ে লোকগুলো কিছু মজবুত ও কর্মঠ। তার কারণ বোধহয় মাছ-মাংসটা খুব খায়।’ তবে সেখানে রান্নাবান্নায় অতিরিক্ত তেল দেওয়া ও তার ক্ষতি নিয়েও বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘খাওয়াদাওয়াতে খুব তেল চর্বি দেয়, ওটা ভালো নয়। তেল চর্বি বেশি খেলে শরীরে মেদ জন্মায়’।
পূর্ববঙ্গের নদীর বিশালতা ও মাধুর্য ঢাকা ঘুরে আসার বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তাঁর মনে গেঁথে ছিল। এর প্রমাণ মেলে, ঢাকা-ভ্রমণের তিন মাস বাদে, ৫ জুলাই শ্রীমতী মেরি হলকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে। সেখানে স্বামীজি লিখছেন, ‘তুমি জানো, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু তার তাৎপর্য পূর্বে কখনো এমনভাবে উপলব্ধি করিনি। পূর্ব বাংলার নদীগুলি যেন তরঙ্গসংকুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয় এবং সেগুলি এত দীর্ঘ যে স্টিমার সপ্তাহের পর সপ্তাহ এদের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে।’
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)