কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, শিবাশিস মৌলিক: নিয়োগ দুর্নীতিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চাকরি গিয়েছে প্রায় ২৬ লক্ষ মানুষের। রাতারাতি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে হাজার হাজার চাকুরিজীবীর। শীর্ষ আদালতের এই রায়ে চাকরিহারাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সঙ্কট নেমে এসেছে, তেমনই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাতেও ঘোর সঙ্কট নেমে এসেছে। কোনও স্কুলে চাকরি গিয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকার, কোনও স্কুলে চাকরি গিয়েছে এক তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকার। বাদ যাননি শিক্ষাকর্মীরাও। আর এই পরিস্থিতিতে বড় প্রশ্ন হল, স্কুলে পড়াবেন কারা? যাঁরা উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই বা কী ব্যবস্থা নেবে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ? সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত ধোঁয়াশা। (SSC Scam Verdict)
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীদের চাকরি যাওয়ায় মাথায় হাত পড়ছে বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষিকাদের। কারণ এমনও স্কুল রয়েছে, যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষককে চাকরি হারাতে হয়েছে। মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা ব্লকের অর্জুনপুর হাইস্কুলে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৬৭। এর মধ্যে চাকরি বাতিল হয়েছে ৩৬ জনেরই। অর্থাৎ চাকরিহারার সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি। ৮ হাজার পড়ুয়ার ওই স্কুল চলবে কী করে, উঠছে প্রশ্ন। (SSC Case)
মুর্শিদাবাদেরই আর একটি স্কুল ভগবানগোলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। এই স্কুলে শিক্ষক সংখ্য়া ৬২। ২১ জনেরই চাকরি চলে গিয়েছে। প্রায় ৪ হাজার পড়ুয়ার এই স্কুল চলবে কী করে বুঝে উঠতে পারছেন না প্রধান শিক্ষিকা। ভগবানগোলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা দীপান্বিতা রায় বলেন, “এতজন যদি আমার স্কুল থেকে চলে যায়, সামনে পরীক্ষা, আগামী কাল থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে স্কুল ভীষণ ভাবে বিপর্যস্ত হবে।”
দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি হাইস্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা ২৪ জন। চাকরি বাতিল হয়েছে আট জন শিক্ষকের। এবার স্কুল সামলাবেন কী করে ভেবে মাথায় হাত প্রধান শিক্ষকে কালিমুল হকের। তাঁর কথায়, “আমাদের স্কুলের আট জন। আট জন বাদ যাবেন। আমার মতো রাজ্য জুড়ে অনেক স্কুল আছে। প্রভাব পড়বে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা কোলাপস করে যাবে।”
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরই এদিন নবান্ন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ভুলে যাবেন না, এঁরা সবাই স্কুলে পড়ান। স্কুলগুলির কী হবে, শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়াই কি বিজেপি-র লক্ষ্য? বাংলাকে আর কত নিশানা করবেন? যাঁদের বাতিল করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১১ হাজার ৬১০ জন নবম এবং দশমে পড়াতেন। ৫৫৯৬ জন একাদশ-দ্বাদশে পড়াতেন। বাকিরা অন্য শ্রেণিতে। নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের গুরুত্ব জানেন। এঁরা অনেকে খাতাও দেখছেন। ২৬ হাজারকে বাতিল করা হলে স্কুলে পড়াবেন কে? তার মানে কি বিজেপি, সিপিএম শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চাইছে? একবার লজ্জা হল না? সিপিএম নিজের আমলে কী করত? চিরকূটে চাকরি দিত। গণশক্তি যতজন রিপোর্টার চাকরি করেন, তাঁদের স্ত্রীদের চিরকূটে চাকরি দিয়েছেন। কই তার তো তদন্ত হয় না! বিজেপি-র রাজ্যে তো তদন্ত হয় না! কেউ অপরাধ করলে সমান সাজা হওয়া উচিত। শুধু বাংলার মানুষের ভাগ্য়ে সারাক্ষণ কেন ব্যাভিচার, দূরাচার, দুষ্টাচার, মিথ্যাচার, দর্ভোগ, দুর্যোগ, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা কেন থাকবে?” মমতা আরও বলেন, “এটা নিয়ে আমরা কিছু ভাবছি। সেটা এখনই প্রেসকে বলব না। আমাদের ভাবনাটা ভাবনার মধ্যেই থাকতে দিন। আমরা আইনতই লড়ব।”
এই গোটা পরিস্থিতির জন্য যদিও রাজ্য সরকারকেই দায়ী করছেন বিরোধীরা। নিয়োগে যদি দুর্নীতিতে ভরা না হত, তাহলে চাকরিও যেত না, স্কুলগুলোর এই হালও হত না বলে দাবি করছেন তাঁরা। বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা বলেন, “যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে। SSC প্রশ্নের মুখে। পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে এটা হয়েছে।”
যে শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হয়েছে, তাঁদের অনেকেই উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখছেন। তাঁদের ক্ষেত্রে এবার কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য বলেন, “কিছু খাতা আছে। আমরা বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি কী করা যায়। টোটাল এইচই এবং পরীক্ষক মিলিয়ে ৫০ হাজারের ম্যান পাওয়ার। কতজনের উপর প্রভাব পড়ল, তা দেখতে হবে। এর পরই বলতে পারব খাতা দেখায় আদৌ সমস্যা হবে, না হবে না।” এরইমধ্য়ে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে গরমের ছুটি এগিয়ে আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী জানান, ৩০ এপ্রিল থেকে রাজ্যের প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে গরমের ছুটি পড়ে যাবে। মাত্রাতিরিক্ত গরমের জন্য় কারণেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন তিনি।
আরও দেখুন