
চেহারা অতি রুক্ষ। কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সবুজ মণিজোড়া দেখলে, বুকে যেন কিছু একটা বেঁধে। সেই যুগে ইন্টারনেট ছিল না বটে। কিন্তু আফগানিস্তানের মেয়ে শরবত গুলার ছবি ভাইরাল হওয়া আটকায়নি। আমেরিকার চিত্রগ্রাহক স্টিভ ম্যাকারির তোলা ওই ছবি আজও পৃথিবীর অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে গণ্য হয়। ওই ছবির দৌলত নাম, খ্যাতি, ঐশ্বর্য, সব পেয়েছেন স্টিভ। কিন্তু যে মেয়ের দৌলতে এতকিছু, জীবন যুদ্ধে বার বার ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে সেই শরবতকে।

১৯৭২ সালে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামে, পাশতুন পরিবারে জন্ম শরবতের। সাতের দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করলে, তাঁর গ্রামেও আঘাত নেমে আসে। শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নেন শরবত। মা আগেই মারা যান। ঠাকুমাই দেখভাল করতেন ভাইবোনেদের। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের নাসির বাগ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন তাঁরা।

১৯৮৪ সালে National Geographic-এর হয়ে কর্মরত ছিলেন চিত্রগ্রাহক স্টিভ। যুদ্ধের ছবি তুলতে আফগান-পাক সীমান্তে পৌঁছন তিনি। স্টিভ যখুন নাসির বাগ শরণার্থী শিবিরে পৌঁছন, শরবত সেখানকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন। বাকি মেয়েদের সঙ্গে তাঁরও ছবি তোলেন স্টিভ।

পাশতুন সংস্কৃতিতে পরিবারের সদস্য ছাড়া, বাইরের পুরুষদের সামনে মুখ অনাবৃত রাখেন না মেয়েরা। তাই স্টিভের সামনে কিছুতেই মুখের কাপড় সরাতে রাজি হননি শরবত। কিন্তু ১২ বছরের শরবতের চোখ এতই আকর্ষণ করেছিল যে, এক শিক্ষিকাকে দিয়ে জোর করে শরবতের মুখ থেকে কাপড় সরানো করান স্টিভ। চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন শরবত।

ছবি পেয়ে খুশি হয়ে চলে যান স্টিভ। গোড়াতে পত্রিকায় ওই ছবি ছাপতে রাজি হননি সম্পাদক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৫ সালের জুন মাসে ‘Afghan Girl’ হিসেবে উল্লেখ করে শরবতের ছবিটি প্রকাশ করে National Geography. ওই ছবি সামনে আসতেই শোরগোল পড়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সেখানকার শরণার্থীদের মুখ হয়ে ওঠেন শরবত।

১৯৮৫ সালের পর ২০০২ সালে এবং ২০১৩ সালে, তিন তিন বার শরবতের ওই ছবিটি National Geography-র প্রচ্ছদে জায়গা করে নেয়। তিন-তিন বার কোনও পত্রিকার প্রচ্ছদে জায়গা করে নেওয়া একমাত্র ছবি সেটি। শরবতের ওই ছবিটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, স্টিভের স্টুডিও থেকে ছোট আকারের ছবি ১৮০০০ ডলারে (১৫.৫ লক্ষ টাকা) এবং বড় আকারের ছবি ১৭৮৯০০ (১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা) বিকোয়। কিন্তু ওই টাকার কানাকড়িও পাননি শরবত। বরং ১৭ বছর পর নিজের ওই ছবিটি দেখার সুযোগ হয় তাঁর।

একটি ছবির দৌলতে গোটা পৃথিবী তাঁকে চিনলেও, শরবতের জীবনের অন্ধকার কিন্তু দূর হয়নি। তাঁর ছবি বিক্রি করে কিছু মানুষ কোটি কোটি টাকা আয় করলেও, শরবতকে নিদারুণ জীবন যন্ত্রণা দূর হয়নি। ১৩ বছর বয়সে রহমত গুলার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে যান আফগানিস্তানে। ২০০২ সালের মধ্যে তিন কন্যাসন্তানের মা হন তিনি, যার মধ্যে ছোটটি মারা যায় জন্মের কিছু পরেই। পরে একটি ছেলেও হয়।

বেশ কয়েক বার ব্যর্থ হওয়ার পর, ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে National Geography-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে শরবতকে খুঁজতে নামেন স্টিভ। আফগানিস্তানে পৌঁছন আবারও। নিজেকে শরবত দাবি করে বহু মেয়ে এগিয়ে আসেন সেই সময়। শেষ পর্যন্ত সফ্টওয়্যার দ্বারা মুখ মিলিয়ে শরবতের খোঁজ পান স্টিভ। সেবারও শরবতের ছবি তোলেন তিনি, যা সামনে আসার পর দেখে যায়, চোখের দৃষ্টি আগের মতোই তীক্ষ্ণ রয়েছে শরবতের। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়।

কিন্তু স্টিভ এবং National Geography-র উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে সেই সময়। শরবতকে সাহায্য করার পরিবর্তে, তাঁর ছবি বিক্রি করে মুনাফা ঘরে তোলার অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে পাকিস্তানে যখন গ্রেফতার হন শরবত, তাঁর অবস্থা দেখে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব। ২০১২ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত হয় মারা যান শরবতের স্বামী রহমত। এর পর ২০১৪ সালেই পাকিস্তানে দেখা যায় শরবতকে। ২০১৬ সালে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়। জানা যায়, বেআইনি ভাবে পাকিস্তানে মাথা গুঁজে ছিলেন শরবত। জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে বাস করছিলেন সন্তানদের নিয়ে। পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয় শরবতকে। সেই ভিডিও ফলাও করে দেখানো হয় টেলিভিশনের পর্দায়।

সেই সময় আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিলেন আশরফ গনি। শরবতকে কাবুলে প্রেসিডেন্টের ভবনে স্বাগত জানানো হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শরবত ও তাঁর সন্তানদের ৩০০০ স্কোয়্যার ফুটের একটি বাড়িও দেয় তদানীন্তন আফগান সরকার। মাসে মাসে ৭০০ ডলার বরাদ্দ হয়, স্বাস্থ্যবিমাও করে দেওয়া হয়। কিন্তু আরও যন্ত্রণা অপেক্ষা করছিল শরবতের জীবনে। ২০২১ সালে তালিবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলে, সবার আগে সমাজে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের নিশানা করা হয়। সেই সময় শরবতের ত্রাতা হয়ে এগিয়ে যায় ইতালি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আবেদনে সাড়া দিয়ে শরবত ও তাঁর পরিবারকে উদ্ধার করে নিজেদের দেশে আশ্রয় দেয় ইতালির সরকার।

তালিবান শাসন থেকে পালিয়ে, সেই থেকে ইতালিতেই রয়েছেন শরবত। ছেলেমেয়েরা সেখানেই পড়াশোনা করেন। ইতালি যে তাঁদের নতুন করে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে, তার জন্য দেশের সরকারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। কিন্তু যে ছবি গোটা পৃথিবীতে তাঁকে পরিচিতি দেয়, তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যন্ত্রণা ধরা পড়ে শরবতের কণ্ঠস্বরে। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “ওই ছবি আমার জীবনে একাধিক সমস্যা ডেকে আনে। ওই ছবি না তুলতেই পারত। ওই ফোটোগ্রাফার যখন এসেছিলেন, আমি ছোট। ছবি তুলতেই চাইনি। আফগানিস্তানের সংস্কৃতি অনুযায়ী, মেয়েরা ছবিতে মুখ দেখায় না। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।” লেখাপড়া যে হয়নি, তার জন্য আজও আফশোস করেন শরবত।
Published at : 24 Jun 2025 07:49 AM (IST)
আরও জানুন খবর
আরও দেখুন