কলকাতা: রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই নির্বাচনী হুঙ্কার শমীক ভট্টাচার্যের গলায়। তাঁর দাবি, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের পরাজয় ঘটছেই। পৃথিবীর কোনও শক্তি মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়কে চতুর্থবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী করতে পারবে না বলে ঘোষণা করলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে, বিজেপি ছাড়া অন্য উপায় নেই বলেও জানালেন।
বছর ঘুরলেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, তার আগে সরকারি ভাবে বৃহস্পতিবার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন শমীক। আর বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েই পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূলকে উৎখাত করার ডাক দিলেন তিনি। শমীক বলেন, “বাংলায় বিজেপিই পারে তৃণমূলকে হারাতে। বিজেপি তৃণমূলকে হারাবে, তৃণমূল হারতে চলেছে, তৃণমূলের বিসর্জন অবশ্যম্ভাবী।”
নির্বাচনী বিজেপি আদৌ তৃণমূলের মোকাবিলা করতে পারবেন কি না, সেই নিয়ে কম বিচার-বিশ্লেষণ চলছে না। মমতার বিকল্প মুখ বিজেপি তুলে ধরতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। তবে শমীকের কথায়, “মমতার মুখ কোথায়? নতুন বিতর্ক। আরে যে মুখকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করছেন, যে মুখকে বিসর্জন দিতে চাইছেন, তার বিকল্প মুখের প্রয়োজনই নেই। তৃণমূল চলে যাচ্ছে, তৃণমূলের বিসর্জন হচ্ছে। বাংলার মানুষ মুক্তি চান, বাঁচতে চান, শিল্প চান, বাংলার মেধাকে বাইরে যেতে দিতে চান না, ঘরের ছেলেকে ঘরে রাখতে চান।”
তৃণমূল বাংলাকে বাজারে পরিণত করেছে, আলু-পটলের মতো মেধা, চাকরি বিক্রি হচ্ছে, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আইটি শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন, ১৮ হাজার টাকার চাকরি করতে বেরোতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন শমীক। তিনি জানান, ইংরেজরা আসার আগে শিল্প উৎপাদন এবং বাণিজ্যে ভারতের অবদান ছিল ৪০ শতাংশ। ইংরেজ আমলে তা কমে ৩০ শতাংশ হয়। কিন্তু মমতা এমন বাংলা বানিয়েছেন, যাতে অবদান ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মমতার ভ্রান্ত নীতির জন্যই আলুচাষিরা আত্মহত্যা করছেন, বামেরাও পাশে নেই বলে দাবি করেন শমীক। চাল উৎপাদনে বাংলা এক থেকে তিনে নেমে গিয়েছে বলেও জানান তিনি।
১৯৪৬ সালের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করেন শমীক। বলেন, “কোন কলকাতা এটা? ১৯৪৬-এর পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন মমতা। সেই সময় মধ্য কলকাতায় মহিলাদের উরু কেটে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল আতঙ্ক তৈরি করতে। স্লোগান উঠেছিল, ‘পহেলে পাকিস্তান দেনা পড়েগা, তব হি ভারত স্বাধীন হোগা’, ‘কান মেঁ বিড়ি, মুহ্ মেঁ পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। মমতা বলছেন পশ্চিমবঙ্গ নাম চান না, শুধু বাংলা রাখতে হবে। ইংরেজিতে W দিয়ে লেখায় পশ্চিমবঙ্গ নীচে থাকে, তাই নাকি এমন দাবি! বড় নেতা রা তো সভায় সবার শেষেই বলেন? আসলে বাংলার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য।”
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর তৃণমূল বিজেপি-র বিরুদ্ধে বর্বরোচিত আক্রমণে নেমেছিল বলেও দাবি করেন শমীক। তাঁর বক্তব্য, “একটা রাজনৈতিক দল, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মানে না, প্রতিদিন বিচারব্যবস্থাকে আক্রমণ করে চলেছে, একজন মুখ্যমন্ত্রী অশোক স্তম্ভের নীচে বসে, সরকারি দফতর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করছেন, বিধানসভার স্পিকার সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। মানুষ এর জবাব দেবেন।”
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের রাশ কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে নেই, বরং মানুষই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে এদিন জানান শমীক। তাঁর কথায়, “এই নির্বাচন আর কোনও দলের হাতে নেই। বাংলার মানুষ ঠিক করে নিয়েছেন, তৃণমূলকে বিদায় দেবেন। স্বয়ং জগন্নাথ দেবকে দিঘায় টেনে আনা হয়েছে। কারণ কালীঘাটের মা কালীও হাত তুলে নিয়েছেন। বলেছেন, ‘এ ফাইল আমি নিতে পারব না। আমার পক্ষে বাঁচানো সম্ভব নয়’। তাই সরাসরি জগন্নাথ দেবের কাছে চলে গিয়েছেন। জগন্নাথ দেব স্বেচ্ছায় এসেছেন না বাধ্য হয়ে এসেছেন, জানা নেই। তবে জগন্নাথ দেবেরও ইচ্ছে, বিদায় দেখতে চান, বাংলার মানুষের মুক্তি চান, পরিত্রাণ চান। তাই যে পূর্বমেদিনীপুরের ঐতিহাসিক মাটিতে প্রথম স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার গঠিত হয়েছিল, সেখানেই বঙ্গোপসাগরে তৃণমূলের বিসর্জন হবে। তৃণমূল হারছে। অন্য কোনও পথ খোলা নেই।”
দুর্নীতির প্রসঙ্গে এদিন সরাসরি মমতার দিকে আঙুল তোলেন শমীক। বলেন, “সততার প্রতীক মমতা, এমন কোনও হোর্ডিং আর নেই। এটা বিজেপি বলছে না, তৃণমূলই আর বিশ্বাস করে না। তাই মমতা সততার প্রতীক বলে হোর্ডিং লাগাচ্ছে না। অটলবিহারি বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের তোলা মিথ্যে অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। কলকাতায় হোর্ডিং পড়ল, ‘ক্ষমতা নয় সততা, দেখিয়ে দিল মমতা’। সেই সততার প্রতিমূর্তি কে, বাংলার মানুষের সামনে নতুন করে আর বলার দরকার নেই। বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে বদ্ধপরিকর বিজেপি।”
সিপিএম এবং কংগ্রেসকে বার্তা দিয়ে শমীক বলেন, “সিপিএম, বামপন্থী এবং কংগ্রেসের ভাইবোনেদের বলব, ভোট কাটার রাস্তায় গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে তৃণমূলকে ফিরিয়ে আনবেন না। সরাসরি রাস্তায় নেমে মমতার সঙ্গে মিছিল করুন। আমরা লড়াইয়ে প্রস্তুত। নো ভোট টু বিজেপি-র আড়ালে চক্রান্ত করবেন না। বিজেপি কারও দয়ায় এই জায়গায় পৌঁছয়নি। ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক উত্থান দেখিয়েছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে, এমন বাংলা তৈরি করতে চায় বিজেপি। সেই বাংলা গড়ার লক্ষ্যে বিজেপি জিতছে, তৃণমূল হারছে। পৃথিবীর কোনও শক্তি মমতাকে চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতায় আনতে পারবে না।”
তৃণমূলের তুষ্টিকরণের রাজনীতিই বাংলায় বিভাজন তৈরি করেছে বলে মত শমীকের। তাঁর বক্তব্য, “সংখ্যালঘুদের বুঝতে হবে, বিজেপি-র লড়াই তাদের বিরুদ্ধে নয়। হ্যাঁ আপনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যাতে আপনাদের বাড়ির ছেলের হাত থেকে পাথর কেড়ে নিয়ে বই তুলে দেওয়া যায়, তলোয়ারের পরিবর্তে কলম তুলে দেওয়া যায়। এটাই বিজেপি-র লড়াই। আমি চাই, দুর্গাপুজো এবং মহরমের মিছিল একই সময়ে, একই রাস্তা দিয়ে যাবে। কোনও সংঘর্ষ, কোনও দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন নেই। বাংলাকে বাঁচাতে হবে, বাংলার বহুত্ববাদকে বাঁচাতে হবে, বাংলার মাটিকে রক্ষা করতে হবে।”
তবে যে সময় রাজ্য বিজেপি-র দায়িত্ব গ্রহণ করলেন শমীক, দলের অন্দর থেকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা উঠে আসছে। এদিন সেই নিয়েও কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দেন শমীক। তিনি বলেন, “পুরনোরা মনে রাখবেন, নতুন মানুষ না এলে, দল বাড়বে না। সমাদের সব স্তরের মানুষকে প্রয়োজন। কুমোরটুলি থেকে মানুষ তৈরি করে তো আনতে পারব না! আর নতুনরাও মনে রাখবেন, পরাজয় নিশ্চিত, জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া নিশ্চিত জেনেও, যাঁরা এতদিন পতাকা ধরে রেখেছিলেন, তাঁদের জন্যই আজ এখানে। কোনও নতুন, পুরনো নেই, যাঁর হাতে পতাকা, তিনিই বিজেপি।” শমীকের দাবি, ২০১১ সালে সিপিএম-এর ব্রিগেড সভা দেখে তাদের পরাজয় আঁচ করা যায়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হারবেন বলে ভাবতে পারেননি কেউ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম-কে কিন্তু মানুষই উৎখাত করে দিয়েছেন। অমিত শাহ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় ভোটকুশলী। দ্বিতীয়টি এখনও জন্মাননি। এখন যারা ২০০ পার বলে ডাক দিচ্ছে, এবার তা হবে না। তৃণমূলকে পরপারে পাঠিয়ে দেবে বিজেপি।