কলকাতা: দেখতে দেখতে এক বছর পার হতে চলল। কিন্তু আর জি কর কাণ্ডের পরও মহালিদের বিরুদ্ধে অপরাধে কোনও বিরাম নেই। একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে, যাতে নয়া সংযোজন কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে আইনের ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে কসবার নির্যাতিতার পরিবারকেও পথে নামার বার্তা দিলেন আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের শিকার হওয়া তরুণী চিকিৎসকের মা ও বা বাবা। (RG Kar Victim’s Family:
আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুবার্ষিকী সামনেই। সেই উপলক্ষে ৯ অগাস্ট ‘অরাজনৈতিক নবান্ন অভিযানে’র ডাক দিয়েছেন তাঁর মা বাবা। ১৪ অগাস্ট ফের ‘রাত দখলে’ও রাজ্যবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পাশে দাঁড়িয়ে গতকালই সেই ঘোষণা করেন আর জি করের নির্যাতিতার বাবা। রবিবার এবিপি আনন্দেও মুখ খুললেন। (RG Kar Case)
সেই ৯ অগাস্টের অভিশপ্ত রাত ফের আসতে চলেছে। তা নিয়ে প্রশ্ন করলে, আর জি করের নির্যাতিতার মা বলেন, “পর পর ৯ তারিখ আসতেই থাকে। আমরা সেই ৯ অগাস্ট যেখানে ছিলাম, আজও সেখানেই আছি। ৯ তারিখ রাতেই ধরা পড়েছিল সিভিক ভলান্টিয়ার। তার পর আর মামলার উন্নতি দেখতে পাইনি। অনেকেই বলছেন, আমরা বিচার পেয়ে গিয়েছি। আমি মনে করি, তদন্ত আদৌ শুরুই হয়নি। কারণ আমার মেয়ে তো মারা যায়নি, দুর্ঘটনা ঘটেনি, কাজের জায়গায় তাকে খুন করা হয়েছিল, ধর্ষণ করা হয়েছিল। সেটা একটা সুরক্ষিত জায়গা। ভিতরের লোক জড়িত না থাকলে, বাইরের কেউ এসে এই কাজ করেনি। ভিতরের কোনও তদন্তই হয়নি এখনও।”
কসবার ঘটনা নিয়েও এদিন প্রতিক্রিয়া জানান নির্যাতিতার মা। তিনি বলেন, “সেই ৯ অগাস্টের মতোই কলেজের, প্রতিষ্ঠানের নগ্ন চেহারা ফুটে উঠল। মনোজিৎ মিশ্র বলুন বা সন্দীপ ঘোষ, রাজনীতির প্রচ্ছন্ন হাত থাকে এদের মাথায়। তাই এরা বেপরোয়া, দুর্নীতি করতে ভয় পায় না। কলেজে কলেজে দাপিয়ে বেড়ায়। এখন ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছি। প্রত্যেক কলেজে থ্রেট কালচার পাবেন। এই থ্রেট কালচারের বলি হয়েছে আমার মেয়ে।”
আর জি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর খুন করে মেরে ফেলা হয়েছিল। কসবার ক্ষেত্রে প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন নির্যাতিতা। আর জি করের নির্যাতিতার মা বলছেন, “আমার মেয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা আর কারও সঙ্গে ঘটেনি। ইতিহাসে ঘটেনি এমন ঘটনা। আমার মেয়ে অন ডিউটি ছিল। ওর অধীনে ৭০-৮০ রোগী ভর্তি ছিল। সেখানে তাকে মেরে ফেলা হল। সারারাত নাকি ঘুমিয়ে ছিল সে? এটা কেউ মেনে নিতে পারে! ঘুমিয়ে থাকলে ডিউটি কেন ছিল? কসবায় মেয়েটিকে আটকে রাখা হয়েছিল, বেরোতে দেওয়া হয়নি। জোর করা হয়েছে। আমার মেয়েকে আটকে রাখতে হয়নি, ডিউটিতে খুন করা হয়েছে। দু’টি কিছুতেই এক ঘটনা নয়, দু’টি আলাদা ঘটনা। কিন্তু থ্রেট কালচারের জায়গাটা মিলে গিয়েছে। কলেজে কলেজে যে থ্রেট কালচার চলছে, তার বলি হতে হচ্ছে। তামান্না তো বাড়িতে মারা গিয়েছে! সেটাকেও থ্রেট কালচার বলব। জিতেছে বলে বোমাবাজি করতে হবে কেন? আমার মেয়ের পর এমন শতাধিক ঘটনা ঘটেছে।”
আর জি কর মামলায় সঠিক সাজা হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলেও মত নির্যাতিতার মায়ের। তাঁর কথায়, “আর জি করে সাজা পায়নি, বিচার পায়নি বলে কত ধর্ষক তৈরি হয়েছে বলুন! আর জি করে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের যদি বিচার হতো, ধর্ষকরা অন্তত ভয় পেত যে, ওখানে এমন বিচার হয়েছিল। কঠোর সাজা পেতে হবে। আমি সব জায়গায় দেখি। অনেকে বলেন, ‘আর জি করে হয়নি, আমাদের কী হবে!’ দুর্নীতিতে প্রচ্ছন্ন মদত দিচ্ছে সরকার। তাতেই এসব বেড়ে চলেছে। কসবার মাকে বলব, আড়ালে থাকলে হবে না। মেয়েদের ছেলেদের আলাদা আলাদা করে…মেয়েদের যে সম্মানহানি করা হচ্ছে, আমার মেয়েকে খুনই করা হয়েছিল। রাস্তায় নামতে হবে, আন্দোলন করতে হবে। অপরাধীদের সাজা দিতেই হবে। মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকলে হবে না।”
আর জি কর কাণ্ডে পুলিশের হাত থেকে তদন্ত উঠেছে সিবিআই-এর হাতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তেও খুশি নন আর জি করের নির্যাতিতার পরিবার। তাঁদের দাবি, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তরুণী চিকিৎসক রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে মারা গিয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ওই সময়ে নির্যাতিতার সঙ্গে কে বা কারা ছিলেন, তাঁদের কেন তদন্তের আওতায় আনা হল না, কেন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না, প্রশ্ন তুলেছেন নির্যাতিতার মা। তাই তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও মানছেন না তাঁরা।
সিবিআই-এর তীব্র সমালোচনা করেন নির্যাতিতার বাবাও। তিনি বলেন, “সিবিআইয়ের ভূমিকা নক্ক্যারজনক বললেও ভুল হয়। খুব খারাপ ভূমিকা। গতকাল বিশ্বজিৎ সরকারের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে চার্জশিট দিয়েছে, তাতে দেখবেন বড় বড় নাম দিলেও, হেফাজতে নেওয়ার কথা নেই। বেকার চার্জশিট দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা। আমরা সিবআই-এর কাছে বিচার চেয়েছিলাম। সিবিআই সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করে দিয়েছে এবং দেখা হলেই গর্বের সঙ্গে আমাদের বলে যে, “আমরা একজনকে দোষী সাব্যস্ত করিয়েছি। আপনারা বিচার চেয়েছিলেন, বিচার দিয়ে দিয়েছি”। আমাদের লড়াই কেন্দ্রীয় সংস্থা, রাজ্য সরকার, রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ে রাস্তা এবং আদালতই একমাত্র উপায় বিচারের। কসবার মেয়েটির মা-বাবাকেও বলব, আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা। এসব মেনে নিলে বিচার পাওয়া খুব মুশকিল হবে। এ রাজ্যে বিচার চেয়ে পাওয়া যাবে না। ছিনিয়ে আনতে হবে। বিচার ছিনিয়ে আনতে গেলে লড়াইটাও সেভাবে করতে হবে। একসঙ্গে রাস্তায় নামতে আহ্বান করছি। প্রয়োজেন সঙ্গে আছি।”
কসবার নির্যাতিতার মা-বাবার উদ্দেশে আর জি করের নির্যাতিতার মা বলেন, “আমাদের গত ১০-১১ মাসের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। পাশে থাকতে চাই এই লড়াইয়ে। সিবিআই সব জানে। অজ্ঞাত কারণে কিছু সামনে আনছে না তারা। আমরা সেই কারণ বুঝতে পারছি না।” নির্যাতিতার বাবার বক্তব্য, “সিবিআই ভারতের প্রথম সারির সংস্থা। আমরা যে কথাই বলি, এড়িয়ে যায়, মুছে দেয়। অর্থাৎ তারা সব জানে, আমরা কিছু জানি না।”
আর জি করের নির্যাতিতার মা-বাবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী অমিত শাহের দফতরেও চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না বলে মত তাঁদের। তাঁরা জানান, বিশ্বজিৎ সরকার জানিয়েছেন, তিনিও শাহের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে এসেছিলেন। কিন্তু কিছু পাননি। নির্যাতিতার মায়ের দাবি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে সঠিক তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সীমা পহুজা তাঁদের জানিয়েছেন। কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা তাঁরা জানেন না। তবে আন্দোলনের উপর ভরসা রাখছেন। কোনও নির্দিষ্ট নেতা বা দল নয়, যে বা যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে থাকবেন, তাঁদের সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
আর জি করের নির্যাতিতার মা বলেন, “অন্যায় কিছুতেই সহ্য মানব না। কসবার নির্যাতিতার মা-বাবা হোন বা তামান্নার পরিবার, সকলে রাস্তায় আসুন। আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা। পুলিশ তথ্য প্রমাণ পায়নি বলছে। সঞ্জয়কে একমাত্র দোষী সাব্যস্ত করেছে ওরা। সেখানে বিচার পাওয়া যাবে না। স্নিফার ডগ আনা হয়েছিল, কিন্তু তদন্ত করার জন্য নয়, প্রমাণ মোছার জন্য। আমাদের যেতে দেওয়া হয়বনি। সাড়ে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখে ধুয়ে মুছে সাফ করা হয়েছিল। তাই পর দিন, ১১ তারিখ সেমিনার হলের পাশের দেওয়ালটা ভাঙা হয়। চেস্ট মেডিসিনের সবাই সই করেছিল তাতে। খুনিরা চেস্ট মেডিসিনে রয়েছে এখনও।”