কলকাতা : শুরুটা হয়েছিল, রাজ্য পুলিশের শীর্ষপদে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্তার আবেদনের ভিত্তিতে। ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’-এর অনুষ্ঠানে পথচলা সেই শুরু। মনের কথা মুখ ফুটে সোজাসাপ্টা বলে দেওয়া রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন আইজি পঙ্কজ দত্ত (Former IG of West Bengal Police Pankaj Dutta) গোড়াতেই নজর কেড়ে নিয়েছিলেন বাংলার আপামর সমাজ সচেতন নাগরিকের। নিজের দৃপ্ত কণ্ঠ, চাঁচাছোলা বিশ্লেষণ ও বাগ্মিতার মাধ্যমে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বাংলার জনপ্রিয় শোয়ের প্ল্যাটফর্মে যোগ দিয়ে। রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কীভাবে তিনি সরব হওয়া শুরু করেছিলেন, পথে কত রকম বাধা এসেছে, সেইসব কথা এদিন সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরলেন এবিপি আনন্দ-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন দে (ABP Ananda Senior Vice President Suman De)। শুধু তা-ই নয়, কঠিন পরিস্থিতিতেও কীভাবে তাঁর ‘চিত্ত ভয়শূন্য’ ছিল তারও উল্লেখ রয়েছে দীর্ঘ সেই পোস্টে।
পঙ্কজ দত্তর প্রয়াণে স্মৃতিমেদুর এবিপি আনন্দ-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এদিন এক্স হ্যান্ডেলে লিখলেন, সাত সকালে রাজ্য পুলিশের শীর্ষপদে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্তার ফোন! সোজাসুজি একটি বিনয়ী সাজেশন – “আমাদের প্রশাসনের দিকটাও তো মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার। অবসরপ্রাপ্ত এক সিনিয়র অফিসার আছেন, তাঁকে মাঝেমধ্যে স্টুডিওতে ডাকলে, পুলিশের দিকটাও একটু প্রতিফলিত হত।”
এ ধরনের অনুরোধ-উপরোধ তো এ পেশায় লেগেই থাকে। তাই ঢেঁকি গেলার স্টাইলেই পাশ কাটিয়ে গেছিলাম, “আচ্ছা, নম্বরটা পাঠিয়ে দিন, দেখছি।”
ফোন রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যে নম্বরটা ঢুকল। পঙ্কজ দত্ত। এক্স আইপিএস। স্মৃতিপটে ভেসে উঠল, শক্ত চোয়ালের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একটা মুখ। বিভিন্ন জেলার এসপি হিসেবে দেখেছি ভদ্রলোককে। তবে ইউনিফর্ম ছাড়া কদাচ নয়।
ইউনিফর্ম ছাড়া প্রথম যেদিন স্টুডিওতে এলেন পঙ্কজ দত্ত, চমকে উঠেছিলেন ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’অনুষ্ঠানের আপামর দর্শক। একটা ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির জায়গাগুলো তুলে ধরেছিলেন পঙ্কজদা-একেবারে পয়েন্ট ধরে ধরে! আমি মনেমনে হেসে ভাবছিলাম, যে কর্মরত আইপিএস যে উদ্দেশ্যে পঙ্কজদাকে রেফার করেছিলেন, এই অনুষ্ঠান দেখে তিনি কতটা আপশোস করবেন?
এটাই পঙ্কজ দত্ত। ভাবনা আর প্রকাশের মাঝে কোনও সাবধানি তফাত রাখতে জানতেন না। ‘মনে করা’ আর ‘মুখে বলা’-র মধ্যে কোনও কৌশলী দেওয়াল তুলতে শেখেননি কখনও।
পঙ্কজ দত্তর এই ইউএসপি-ই চোখের নিমেষে দর্শকদের কাছে চূড়ান্ত জনপ্রিয় করে তুলল পঙ্কজদাকে। বাকিটা ইতিহাস।
তাঁর অবসর-উত্তর গোটা টেলিভিশন-জীবন ধরেই আমবাঙালির কাছে এই জনপ্রিয়তার মাশুলই দিতে হয়েছে পঙ্কজ দত্তকে। শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত। স্বাধীন চিন্তা, গ্রহণযোগ্যতা আর যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা —কবেই বা সহ্য করতে পেরেছে রাষ্ট্রশক্তি? অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বিনা নোটিসে প্রাক্তন আইজি হিসেবে তাঁর প্রাপ্য নিরাপত্তারক্ষী তুলে নেওয়া হয়েছে। তারপর হাইকোর্টের তীব্র ভর্ৎসনার পর, রাজ্য তাঁর নিরাপত্তা ফেরাতে বাধ্য হয়েছে। তবে আর জি কর-কাণ্ডের সময়ে যা হয়েছিল, তা ইস্পাতের মতো স্নায়ুর অধিকারী পঙ্কজ দত্তকেও রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘটনার সূত্রপাত, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত এক নাগরিক কনভেনশনে। তাঁর বক্তৃতায় আবেগপ্রবণ পঙ্কজদা কর্মস্থলে মহিলাদের নিরাপত্তাহীন বোঝাতে অকারণ একটা অসংবেদনশীল তুলনা টেনে ফেললেন!
ব্যাস, মুহূর্তে চূড়ান্ত হেনস্থা করে তাঁর মুখ বন্ধ করার নির্মম পরিকল্পনা করে ফেলা হল। বহুদিন ধরে তো এই সুযোগটাই খোঁজা হচ্ছিল প্রাণপণ!গ্রেফতারের দাবি থেকে বড়তলা থানার নোটিস। প্রাক্তন আইজি-কে উদ্ধত সাব ইন্সপেক্টরের সামনে ৬ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা। নোংরা স্লোগান, পরিকল্পিত বিক্ষোভ—কী নয়? মানছি, ‘শব্দ ব্রহ্ম’, কিন্তু তা বলে যে মানুষটা তাঁর গোটা কর্মজীবনে সমাজের সমস্ত শ্রেণির মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে গেছেন, তাঁর ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ বিবেচনা করা হবে না? আইনের পরিভাষায়, তাঁর বক্তব্যের ‘স্পিরিট অ্যান্ড ইনটেনশন’ দেখা হবে না? একজন আদ্যন্ত সৎ-সাহসী একটা মানুষকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে?
হবে। তার কারণ, যে কোনও মূল্যে পঙ্কজ দত্তর মুখটা বন্ধ করতে হবে যে! বড়তলা থানায় হাজিরার দিন পঙ্কজদার সঙ্গী আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু সিনহা রায়কে অপমান করে থানা থেকে কার্যত বের করে দেওয়া হল। পঙ্কজদাকে নিয়ে কুৎসিত স্লোগান তুলে বড়তলা থানার সামনে পরিকল্পিত বিক্ষোভ করানো হল। কিন্তু বিধি বাম! ‘বঙ্গ টিভি’র রোজিনা রহমানের ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে থাকল, যাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁদের একটা অংশ জানেনই না, পঙ্কজ দত্ত কে, তিনি কী বলেছেন? একজন বিক্ষোভকারিণী তো রীতিমতো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে বলেই দিলেন, পুলিশের কেউ-ই বলেছেন বিক্ষোভ দেখাতে, কার্যত তাঁদের ‘ডেকে এনেছেন!’
এই ঘটনার অভিঘাতে আহত হয়েছিলেন। বাকরুদ্ধ হননি। একদিনের জন্যও না। কারণ, পঙ্কজ দত্ত লড়তে জানতেন। আজীবন। ওই ক্ষীণকায় শরীরে লড়াইয়ের সাহসটা আসত সততা থেকে। নিখাদ সততা। সেই জোরেই বোধহয়, শেষ লড়াইটা লড়লেন ৩৯ দিন ধরে। শেষের দিকে, প্রায় একদিন অন্তর রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছিল। আমার সহকর্মীরা আপ্রাণ করছিল নিখাদ শ্রদ্ধা থেকে। বেনারস থেকে প্রায় প্রতিদিন খোঁজখবর নিচ্ছিলেন ড. কুণাল সরকার, সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, শুভময় মৈত্র, জয়ন্ত, শীর্ষেন্দুরা। তৃণমূলের অন্দরেও বহু মানুষ পঙ্কজদার সঙ্গে হওয়া ঘটনাটা মেনে নিতে পারেননি। নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন তাঁরা। নাম লিখলে হয়তো বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন, তাই নামগুলো আর উল্লেখ করছি না।
অতঃপর যাবতীয় বিড়ম্বনার পরিসমাপ্তি। পঙ্কজ দত্ত আর কোনও দিন ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’ অনুষ্ঠানে, রাত ৮টায় গর্জন করবেন না।
বুড়ো ঘুমোল। পাড়া জুড়োল।
নৈঃশব্দ্যে শ্মশানের শান্তি।
গ্রেফতারির থেকেও বড় বিষয় হল যা হোক।
বেশ, এবার খুশি তো?
সাত সকালে রাজ্য পুলিশের শীর্ষপদে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্তার ফোন! সোজাসুজি একটি বিনয়ী সাজেশন – “আমাদের প্রশাসনের দিকটাও তো মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার। অবসরপ্রাপ্ত এক সিনিয়র অফিসার আছেন, তাঁকে মাঝেমধ্যে স্টুডিওতে ডাকলে, পুলিশের দিকটাও একটু প্রতিফলিত হত।”
এ ধরনের অনুরোধ-উপরোধ তো এ… pic.twitter.com/V05fbrafMF
— Sange Suman (@IamSumanDe) November 30, 2024
আরও পড়ুন ; “পঙ্কজদা, এই অন্ধকার সময়ে আপনাকে যে আরও বেশি করে প্রয়োজন ছিল!”