কলকাতা: রামনবমীর আগে রাজনৈতিক পারদ চড়ছে রাজ্য রাজনীতিতে। সেই আবহে নবান্ন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে শান্তির বার্তা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা জানালেন, ইদ যেমন শান্তিপূর্ণ ভাবে পালিত হয়েছে, রামনবমীতে যেন শান্তি বজায় থাকে। যে কোনও প্রকারে দাঙ্গা, অশান্তি এড়িয়ে যেতে আর্জি জানালেন মমতা। দেশকে ভাঙার চক্রান্ত রুখতে হবে বলে জানালেন। (Mamata Banerjee)
বুধবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বলেন, “দরিদ্র মানুষের সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার আছে কী জন্য? শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রবণতার নামে…একটা নতুন ধর্মের আমদানি করে, যা আমাদের তপোবনের নয়, আমাদের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নয়, যা বেদ-বেদান্তের নয়, যা ঋক-সাম-যজু-অথর্বের নয়…শুধু দেশকে ভাগ করার জন্য, মানুষের মধ্যে দাঙ্গা লাগানোর জন্য? আমি চাই, বাসন্তী পুজো, অন্নপূর্ণা পুজো, রামনবমী সব শান্তিতে, ভাল ভাবে হোক। ইদও শান্তিতে পালিত হয়েছে। সামনের সবকিছুও ভাল ভাবে পালিত হোক। নতুন বছর আসছে, শুভ নববর্ষ। আমাদের মা কালীবাড়ির স্কাইওয়াক, উন্নতি হয়েছে। ১৪ তারিখ উদ্বোধন করব। ২৮ তারিখ জগন্নাথ ধামের উদ্বোধন হবে।” (Mamata Banerjee on Rama Navami)
ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল সংসদ। সেই প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “দলের সাংসদরা ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কারণ জুমলা দলের একটাই কাজ, দেশকে ভাগ করা। ওরা বিভাজনের নীতিতে বিশ্বাসী, আমরা না। আমরা সংবিধান মেনে চলি। আগে সংবিধানকে শ্রদ্ধা কোরো, তার পর অধিকার কাড়তে যেও। মনে রাখবেন, ধর্ম যার যার আপনার, উৎসব কিন্তু সবার। পরিষ্কার বলছি, আমি শ্রীকৃষ্ণের বাণীও শুনি, বিবেকানন্দ, নেতাজি, গাঁধীজি, অম্বেডকর, রামকৃষ্ণ, আবুল কালামও পড়ি। একটাই কথা, কর্ম যার, ধর্ম তার। ধর্ম তখনই সদিচ্ছা লাভ করে যখন কর্ম হয় মানবিক। কর্ম দানবিক হলে কোনও ধর্মকে শ্রদ্ধা করা যায় না। আমি সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি।”
সম্প্রতি অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করার সময়ও হিন্দু হওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল মমতাকে। সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আমাকে বিদেশে গেলে কেন প্রশ্ন করবে আমি কি হিন্দু? ওরা কে? আমি কি বিজেপি-কে উত্তর দিতে দায়বদ্ধ? কালকে আবার ছেড়েছে আমি না কি পদত্যাগ করেছিলাম! আর কত ভুয়ো খবর ছড়াবে! ফেক আর ভেক। আমরা এফআইআর করেছি। যা তা করে বেড়াচ্ছে। এর আগে, বাংলাদেশের ছবিকে মুর্শিদাবাদের বলে চালিয়েছিল, গুজরাত-রাজস্থানের ছবিকে বাংলার বলে চালিয়েছিল। এখনও সেই পরিকল্পনা জুমলা পার্টির। আমি জুমলা পার্টিকে বলব, সত্যিই যদি ধর্মকে ভালবাসেন, বাসন্তী পুজো করুন, নবরাত্রি করুন, অন্নপূর্ণা পুজো করুন। অন্নপূর্ণা পুজোয় আমিও পুজো দিই। যাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিলের নামে দাঙ্গা করেন, ইতিহাসটা জেনে রাখুন। পাঞ্জাবিরাও কৃপাণ নেন। আপনিও ব্যবস্থা অনুযায়ী, পুলিশের নির্দেশ মেনে নিশ্চয়ই পারবেন। কিন্তু অন্য এলাকায় গিয়ে হামলা করা আপনার কাজ নয়।”
এর পরই মমতা বলেন, “এরা যে রামনবমীতে মিছিল করে, আমাদের অনেকেও রামনবমীতে মিছিল করেন, আপত্তি নেই আমাদের। আমরা শুধু চাই শান্তিপূর্ণ হোক। এখন যেটা চৈত্র মাসে হয়, সেটাই ছিল। কিন্তু রাবণকে ধ্বংস করতে রামচন্দ্র যখন অকাল বোধন করেন যখন, সেটাকেই আসল দুর্গাপুজো হিসেবে পালন করি আমরা। এটাও পালন করি, কিন্তু ওভাবে নয়। সবাই সবার মতো করে নবরাত্রি পালন করবে, পুজো করবে, এটাই ধর্ম। শরতে শিউলি, কাশফুল ভাসে। আমরা করিনি, রামচন্দ্র করেছিলেন। সেটা কি রামনবমী নয়? সেটা কি আপনাদের মনে পড়ে না। রামচন্দ্র ১০৭টা ফুল দিয়ে একটা বাকি ছিল বলে নিজের চোখ দিতে গিয়েছিলেন। ইতিহাসটা জানুন। ইতিহাসের এটাই শিক্ষা। কর্ম মানেই ধর্ম, ধর্ম মানে কর্ম। মানবিক হোন, দানবিক হবেন না দয়া করে।”
বিজেপি-র পাশাপাশি বামেদের নিশানা করে মমতা বলেন, “বামপন্থীদের সবাইকে বলি না আমি, অনেকে আছেন, যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, একসময় যাঁরা করতেন, এখন করেন না। কিন্তু বিজেপি-র দোসর আছেন যাঁরা, তাঁদের বলি যে, গৈরিকীকরণ ও রক্তিমকরণকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেবেন না। আপনারাও বড় বড় সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছেন। নির্বাচন থেকে সব ব্যাপারেই বাম-রাম এক, জগাই-মাধাই-গদাই। যত এসব করবেন, তত মহাশূন্য থেকে আরও শূন্যে বিলীন হয়ে যাবেন। আমার অনুরোধ সকলকে, হিন্দু হোন বা মুসলিম হোন, অথবা শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, শান্তি বজায় রাখুন। দাঙ্গা করে অশান্তির চেষ্টা করবেন না দয়াকরে। দাঙ্গা করে কেউ কোনও দিন কিছু করতে পারেনি, আর করবেও না। বাংলা আর যাই হোক না কেন, বাংলা সংস্কৃতির জন্ম দেয়, বাংলা সম্প্রীতির জন্ম দেয়। আমরা রামকৃষ্ণকে মানব, জুমলা পার্টিকে মানব না। মা সরস্বতীর বচন মানব, জুমলা পার্টিকে নয়। যে ধর্ম সকলকে শ্রদ্ধা করে, আপন করে নেয়, সেই ধর্মকে মানি। আমরা সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি। আমরা অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজো, রামনবমী, চৈত্র সংক্রান্তি, চড়ক… আরও নানা কিছু হয়। অন্যের উৎসবকে ডিস্টার্ব করতে যাবেন না। আমি সবাইকে নিয়ে চলি, আপনারা কেন পারেন না?”
সবাইকে ভাল থাকতে বলে মমতা বার্তা দেন, “যে ধর্মের যে, সবাই ভাল থাকুন। আমাদের মধ্যে যেন বিভেদ না হয়। ঐক্য এবং সম্প্রীতিই বাংলার সম্পদ। বাংলা শান্তির মাটি। বাংলা কখনও বিভাজন মানে না। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি সবাইকে ভুলে যাব? বেলুড়মঠেও দরগা আছে। তাঁরা তো ভেঙে সরাননি? তাঁরা যদি এক জায়গায় থাকতে পারেন, আমরা কেন পারি না? রামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের ছবি রাখি বেদীতে। কারণ মানবিক দেব-দেবতা হিসেবে তাঁদের পুজো করি আমরা।” ক্যান্সার-সহ জীবনদায়ী ওষুধের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নামার ঘোষণাও করেছেন মমতা। তিনি ৬ এপ্রিল রামনবমী, তার আগে ৪ ও ৫ এপ্রিল ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্লকে ব্লকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। সাধারণ মানুষকেও নিজেদের মতো করে ওষুধের দাম বৃদ্ধির প্রতিবারে রাস্তায় নামতেে আহ্বান জানান মমতা। তিনি বলেন, “অন্যথায় কেন্দ্রের এই একতরফা স্বেচ্ছাচারী আচরণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পড়ে যাবে। আর কত টাকা পেলে কেন্দ্র জুমলাবাজি বন্ধ করবে? স্বাস্থ্যবিমায় কেন জিএএসটি দিতে হবে? সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ কোথায় যাবে?”