কলকাতা: বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরোধিতা হচ্ছিলই। এবার সটান সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানালেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্য রাজ্যগুলির উপর কমিশনের পদক্ষেপে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন তিনি। বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গেও ওই নিয়ম কার্যকর করাই লক্ষ্য বলে আশঙ্কা মহুয়ার। (Voter List Revison)
এবিপি আনন্দের মুখোমুখি হয়ে মহুয়া বলেন, “২০২৬ সালে আমাদের নির্বাচন। কীভাবে বিজেপি-কে সাহায্য় করে, বাংলার ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যায়, এটাই মূল উদ্দেশ্য। যে ১১টি প্রমাণপত্র চাওয়া হয়েছে, তাতে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড নেই। প্রমাণপত্রের মাধ্যমে জন্মের স্থান প্রমাণ করতে হবে। জন্মের শংসাপত্র ছাড়া আরও কোথাও জন্মের স্থানের উল্লেখ থাকে না। ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম, তাঁদের মা-বাবার প্রমাণপত্রও দিতে হবে।” (Mahua Moitra)
পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোটাধিকার বাতিলের চক্রান্ত চলছে বলেও দাবি করেন মহুয়া। তাঁর কথায়, “ধরুন কোনও পরিযায়ী শ্রমিক হায়দরাবাদে কাজ করছেন। তাঁর ভোটার কার্ড বাতিল করা হল। ১ অগাস্ট থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে বাড়ি আসতেই পারলেন না তিনি। সেক্ষেত্রে নাম বাতিল করে দেওয়া হবে। আগে শুনানির সুযোগ ছিল, সেটাও পাবেন না। ফর্ম ৬ ভরে আবার আবেদন করতে হবে নতুন করে। এই সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক, মমতাদিও বলেছেন সেকথা। আমি আদালতে গিয়েছি। বাংলায় এটা অবশ্যই করবে ওরা। বিহারের পর বাংলায় এটা করাই ওদের পরিকল্পনা। বাংলায় চিফ ইলেক্টোরাল অফিসার নির্দেশও দিয়ে দিয়েছেন।”
এর আগে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষয়টি নিয়ে সরব হন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “মা-বাবার জন্মের শংসাপত্র দিতে হবে বলছে। বিহারে বিজেপি-র সরকার। ওখানে কিছু করবে না। আসলে বাংলাকে লক্ষ্যে রেখেই এটা করা। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে। ভয় পেয়েছে ওরা। কমিশন একতরফা ভাবে এগুলো করছে, রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কথা না বলেই। এভাবে নতুন করে ভোটার তালিকা করা যায় না। আসলে NRC কার্যকর করতে চাইছে। গ্রামের লোকেদের নাম বাদ যাবে, সেই জায়গায় বাইরের লোক দিয়ে অনলাইন ফর্ম ভরাবে।”
মহুয়া আদালতে যাওয়ার পর, কমিশনের সমালোচনা করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনিও বলেন, “এটা জরুরি। কমিশন যে এটা করছে, সেটা গণতন্ত্রের জন্য বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলবে। কারণ মূল আদর্শ হচ্ছে, মানুষের মতামত প্রকাশের অধিকার, ভোটদানের অধিকার। সেটা কেড়ে নেওয়া হলে কমিশন কাদের জন্য, কিসের জন্য, কার স্বার্থে কাজ করছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। কমিশন যা খুশি করতে পারে না। এই অপচেষ্টা সফল হতে পারে না কিছুতেই।”
যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, “এখানে ভোটার তালিকায় প্রচুর রোহিঙ্গা মুসলিম আছে। তারা শরণার্থী নয়, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। তাদের নাম বাদ গেলে তৃণমূলের অসুবিধা হবে। মমতার ভোটব্যাঙ্কে ১২-১৪ বছরের বালকের নাম আছে। ভুয়ো ভোটারের নাম বাতিল হয়ে যাবে। ২০ শতাংশ ভোট কমে যাবে ওদের। ৪টে থেকে ৬টা পর্যন্ত ক্যামেরা বন্ধ করে যে ভোট হয়, সেটা হবে না বলেই সমস্যা।”
বিহারে ভোটার তালিকায় যে বিশেষ সংশোধনী কর্মসূচি শুরু হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০০৩ সাল থেকে নাম তালিকায় ওঠা মানেই সেই ভোটার বৈধ নন। অর্থাৎ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বৈধ নন। নতুন করে নাম তুলতে হবে। প্রমাণ করতে হবে নিজেদের বৈধতা। এর ফলে বিহারের প্রায় ৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজের পরিচয়পত্র, সরকারি বা রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার কর্মী হলে সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র। এক্ষেত্রে যে প্রমাণপত্র চাওয়া হয়, সেগুলি হল—
- ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, LIC বা রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা প্রদত্ত নথি।
- প্রশাসনের তরফে দেওয়া জন্মের শংসাপত্র।
- পাসপোর্ট।
- মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট বা সরকার স্বীকৃত বোর্ড বা বিশ্ববিদ্য়ালয়ের সার্টিফিকেট।
- স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার প্রমাণপত্র।
- জনজাতিদের ক্ষেত্রে জঙ্গলের অধিকারের শংসাপত্র।
- SC, ST, OBC-দের জাতি শংসাপত্র।
- নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র।
- রাজ্য বা স্থানীয় প্রশাসনের তরফে দেওয়া পরিবারের নাম নথিভুক্তির প্রমাণপত্র।
- জমি বা বাড়ির কাগজ।
তবে প্রমাণপত্র হিসেবে কোথাও আধার বা ভোটার কার্ডের উল্লেখ নেই। সেই নিয়ে গোড়া থেকেই আপত্তি তুলে আসছেন বিরোধীরা। বছর ঘুরলে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। বিহারকে বোড়ে করে আসলে পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন তাঁরা। কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আর সেই আবহেই আদালতে গেলেন মহুয়া।