বিটন চক্রবর্তী, পূর্ব মেদিনীপুর : “মা আমি বলে যাচ্ছি যে আমি কুড়কুড়াটি রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, চুরি করিনি”। নাবালক হাতের লেখায় মায়ের উদ্দেশে যখন এই কাতর বার্তাটি ভাইরাল হয়, তখন ছোট্ট সে ছেলেটি এই পৃথিবীতে আর নেই। অপমানে, অভিমানে দুমড়ে গিয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। আর মর্মান্তিক এই ঘটনা জেনে নিদারুণ দুঃখ, কষ্ট ভোগ করছেন অগণিত পাঠক, দর্শক, এলাকার মানুষ। শিক্ষার অঙ্গন যখন চুরির অভিযোগে ছয়লাপ, রাস্তায় চাকরিহারা শিক্ষকরা, ঠিক তখন এ রাজ্যের মাটিই সাক্ষী হল মর্মান্তিক এক ঘটনার। চুরির অপবাদে অপমানিত হয়ে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আত্মহত্য়ার অভিযোগ উঠল পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়। অভিযোগ, ক্লাস সেভেনের ছেলেটি এই সিদ্ধান্ত নেয় পাড়ার দোকান থেকে একটি চিপসের প্য়াকেট চুরির অপবাদ ওঠার পর। অভিযোগ, তাকে কানধরে ওঠবোসও করতে হয়েছিল । তারপরই গত রবিবার কীটনাশক খায় ছেলেটি। অভিযুক্ত স্থানীয় এক দোকানদার। তিনি আবার সিভিক ভলান্টিয়ারও।
আরও পড়ুন, কেরলে এক সপ্তাহ আগেই বর্ষা, আরব সাগরে শক্তি বাড়িয়ে সুস্পষ্ট নিম্নচাপ, রাজ্যের সব জেলায় প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনা ! ৩০-৫০ কিমি বেগে বইবে ঝোড়ো হাওয়াও..
কীটনাশক খাওয়ার পর বাচ্চাটিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল তাম্রলিপ্ত মেডিক্য়াল কলেজ হাসপাতালে। চারদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর মৃত্য়ুর কাছে হার। পরিবারের দাবি, আত্মহত্য়ার আগে সপ্তম শ্রেণির ওই পড়ুয়া খাতায় লিখে যায় – কয়েকটি কথা। “মা আমি বলে যাচ্ছি যে আমি কুড়কুড়াটি রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, চুরি করিনি”।
মর্মান্তিক এই ঘটনার পর সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছেন মৃতের পালিত বাবা জগন্নাথ বেরা। তিনি দোকানদারের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। বলেন, “আমার ছেলেকে সামান্য একটা কুড়কুড়ের জন্য বকাবকি করেছে। আমার ছেলে আজ আর নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কুড়কুড়ে কেনার জন্য। দোকানে কেউ ছিল না। দু’বার ডেকেছে। কুড়কুড়েটা রাস্তায় পড়েছিল। ও কুড়কুড়েটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে আসে। দোকানদার তখন মোটরসাইকেল নিয়ে ধাওয়া করেছে। ধাওয়া করে ওকে ধরে নিয়ে বলেছে, তুই কুড়কুড়েটা চুরি করে এনেছিস। তখন ও বলেছে, না স্যার আমি চুরি করে আনিনি। ও পয়সাও দিয়েছে। তারপরেও দোকানে চল, বলে ওকে দোকানে নিয়ে গিয়েছে। তারপর কানধরে ওঠবোস করিয়েছে। ওর সেটা আত্মসম্মানে লেগেছে। তারপরেই ছেলে আমার বিষ খেয়েছে।”
এদিকে, অভিযুক্ত দোকান মালিক শুভঙ্কর দীক্ষিতের স্ত্রী নিশা দীক্ষিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “রবিবার দিন স্বামী শুভঙ্কর দীক্ষিত দেখে, বাচ্চাটা সাইকেলে লেস- এর প্যাকেট নিয়ে চলে গিয়েছে। তার পিছুপিছু ও বাইক নিয়ে ধাওয়া করে। বাচ্চাটা তখন ভয়ে লেস- এর প্যাকেট ফেলে দেয়। বাচ্চা রোজ এরকম আমাদের দোকানে আসে। ও যদি ঘুমিয়ে থাকে, ওকে ডেকে চকলেট নেয়। এরপর যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তুই আজ কেন এরকম করলি ? বাচ্চাটা নিজেই কান ধরে তখন বলে, কাকু আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা করে দাও। তখন ওখানে কিছু স্থানীয় লোক ছিল। ওনারা এই ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শী। ওর মা আবার এই খবর পেয়ে, তেলে বেগুনে জ্বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে ১৫-২০ মিনিট পর দোকানে আসে। মা দোকানেই বাচ্চাটাকে চড় মারে। আমার স্বামী ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। তখন ওর মা-ই বলে তুই কাকুর কাছে ক্ষমা চা। কানধরে ওঠবস কর। ও কান ধরতেই আমার স্বামী আবার ওকে ছাড়িয়েছে। ওই ২০ টাকার ৫ টাকাও ফেরত দিয়েছে ওর মায়ের হাতে। তারপর সন্ধে সাতটার সময় আমরা শুনতে পাই, বাচ্চাটা নাকি কীটনাশক ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। আমি সঠিক বিচার চাইছি। আমার স্বামী নির্দোষ। আমি সেটার সঠিক বিচার চাইছি। বাচ্চাটা যে মারা গিয়েছে, তাঁকে তো ফিরিয়ে কোনও দিন আনতে পারব না। কিন্তু এই বদনাম নিয়ে বাঁচতে চাই না।”
অন্যদিকে, মৃত পড়ুয়ার আত্মীয় সুবোধ দাস বলেন, “মেন্টালি টর্চার করে দোকানদার। বাচ্চাটা চুরি করেনি। ও দোকানদারকে টাকাটা পরে দিয়েও দিয়েছিল। জানিয়েছিল, যে কুড়িয়ে পেয়েছিল প্যাকেটটা। তারপরেও বাচ্চাটাকে ধরে এনে সারা বাজারের সামনে কান ধরে চড়-থাপ্পড় মেরেছে।
রবিবার রাতে মৃতদেহ এলাকায় পৌঁছতেই ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। অভিযুক্ত দোকানদারের বাড়িও ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ। মৃত্য়ু ঘিরে কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে এলাকা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় পুলিশকে। অভিযোগ, পুলিশকে লাঠিও চালাতে হয়। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে বলে খবর।
আরও দেখুন