কলকাতা: প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব, প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও। বাম জমানায় এবং তৃণমূল জমানায় বাংলায় কাজ করেছেন যেমন, তেমনই মনমোহন সিংহের আমলেও সচিব ছিলেন। প্রাক্তন IAS জহর সরকার তিন বছর আগে রাজনীতিতে প্রবেশ করায় তাই আশার আলো দেখেছিলেন অনেকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল তাঁকে সাংসদ হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল। কিন্তু আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে এবার সেই পদ ছাড়লেন জহর। শুধু তাই নয়, বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকেও সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। (Jawhar Sircar)
আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় উত্তাল গোটা দেশ। ঘরে-বাইরে প্রশ্নের মুখে পড়ছে তৃণমূল। সেই আবহেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা এবং রাজনীতি ছাড়ার কথা জানালেন জহর। দুই পাতার চিঠিতে আর জি করের ঘটনার যেমন নিন্দা করেছেন জহর, তেমনই যাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে আসা, সেই মমতার ভূমিকাতেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। আগের সেই মমতাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন জহর। মমতাকে চিঠিতে ঠিক যা লিখেছেন জহর-
‘রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি সংসদে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আপনাকে জানাচ্ছি যে, সংসদীয় পদ এবং রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি’। (Mamata Banerjee)
‘আপনার জন্যই দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মকে একেবারে উচ্চস্তর থেকে বোঝার সুযোগ হয়েছে গত তিন বছরে। কিছু পাওয়ার জন্য বা দলে পদ পাওয়ার জন্য রাজনীতিতে আসিনি আমি। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা থাকলে ৬৯/৭০ বছর বয়সে কেউ রাজনীতিতে আসে না। দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় যোগদান ছাড়া সাংসদ হওয়ার লক্ষ্য ছিল একটিই, বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ববাদী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতায় লড়াই চালিয়ে যাওয়া। কর্তৃত্ববাদী, বিভাজনকারী, বৈষম্যকামী এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সেই কাজ যে কিছুটা করতে পেরেছি, সংসদ টিভি এবং ইউটিউবে তার প্রমাণ রয়েছে’।
‘কিন্তু যোগদানের একবছর পর, ২০২২ সালে টিভি-র পর্দায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার প্রমাণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলাম যে, সরকার এবং দলকে দুর্নীতি সামলাতে হবে। তাতে দলের সিনিয়র নেতারা হেনস্থা করেছিলেন আমাকে। সেই সময় পদত্যাগ করিনি, কারণ আশা ছিল, আপনি কাটমানি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার করবেন, যা একবছর আগে শুরু করেছিলেন। প্রত্যেকে জানেন, কোনও দলই দুর্নীতিমুক্ত নয়। শুভাকাঙ্খীরা আমাকে বোঝান, সাংসদ পদে থেকে যেতে, যাতে গণতন্ত্র এবং নাগরিক স্বাধীনতা বিরোধী কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায়’।
‘সংসদে আমি আমার কাজ করেছি। কিন্তু দুর্নীতি এবং দলের ক্ষমতাশালীদের প্রতি রাজ্য সরকারের যে উদাসীন আচরণ, তাতে মোহভঙ্গ হয়েছে আমার। আপনি জানেন, আমিই একমাত্র অফিসার, যাকে পূর্বতন সরকার সল্টলেক বা অন্য কোথাও কোনও জমি দেয়নি। কারণ আমি তাদেরও সমালোচনা করেছিলাম। কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। গণ পরিবহণে দমবন্ধ অবস্থায় যাতায়াত করেছি, বাসের পাদানিতে ঝুলে গিয়েছি। তাই ৪১ বছর IAS থাকার পর মধ্যবিত্ত, ছোট ফ্ল্যাটে অস্বস্তি ছাড়াই বাঁচতে পারি, যা বস্তির ঠিক পাশেই। ন’বছর পুরনো সাধারণ গাড়ি চালাই। কিন্তু অবাক হয়ে যাই, পঞ্চায়েত এবং পুরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিপুল সম্পত্তির মালিক হতে দেখে, দামি গাড়ি চড়তে দেখে। শুধু আমিই আহত হই না, বাংলার মানুষজনও আহত’।
‘এটাও সত্য যে, অন্য দল এবং অন্য রাজ্যের নেতারাও প্রচুর সম্পত্তি করেছেন। কিন্তু বাংলা এই বেহিসেবি দুর্নীতি এবং কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ মেনে নিতে পারছে না। আমি জানি, বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকার ধনকুবেরদের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, যাদের তারা নিজেরাই আরও সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। একটি দিনও কাটে না, যখন আমি তাদের নোংরা, পুঁজিবাদী নীতির সমালোচনা করি না। কিন্তু কিছু জিনিস একেবারেই মেনে নিতে পারি না আমি, যেমন, দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার (বা চিকিৎসক), যাঁরা সেরা পদ পেয়ে যান, ভাল পোস্টিং পেয়ে যান’।
‘বিশ্বাস করুন, বর্তমানে মানুষের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ দানা বেধেছে, তা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই। এত বছরে সরকারের বিরুদ্ধে এত অনাস্থা, এত ক্ষোভ দেখিনি আমি, সে সরকার ঠিক হোক বা ভুল। আর জি করের মর্মান্তিক ঘটনার পর একমাস ধৈর্য ধরেছিলাম। আশা ছিল, প্রতিবাদী জুনিয়র চিকিৎসকদের নিয়ে বিষয়টিতে আপনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন, সেই পুরনো দিনের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো। এখনও পর্যন্ত তা হয়নি। এখনও পর্যন্ত সরকার যে পদক্ষেপ করেছে, তা অতি সামান্য এবং অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্তদের ঘুঘুর বাসা যদি আগে ভেঙে দেওয়া হতো, দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হতো, এই লজ্জাজনক ঘটনার পরই যদি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে পরিস্থিতি হয়ত স্বাভাবিক হয়ে যেত’।
‘আমার মনে হয়, মূলস্রোতের যে আন্দোলন হচ্ছে, তা অরাজনৈতিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। একে প্রতিহত করা সঠিক নয়, রাজনৈতিক বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। অবশ্যই বিরোধী দলগুলি ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। কিন্তু যুবসমাজ এবং সাধারণ মানুষ, যাঁরা রাস্তায় রোজ হাজির হচ্ছেন, তাঁরা রাজনীতি করছেন না। বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, অভয়ার জন্য এই আন্দোলন রাজ্য সরকার, দলের বিরুদ্ধে। অবিলম্বে ভুল শুধরে নিতে হবে, নইলে রাজ্য দখল করবে সাম্প্রদায়িক শক্তি’।
‘এসব লিখে বলতে হল, কারণ কয়েক মাস আপনার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ হয়নি। আবারও আপনাকে ধন্যবাদ জানাই তিন বছর রাজ্যের সমস্যা সংসদে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আর সাংসদ থাকতে চাই না। দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেও। এর সঙ্গে আপস করতে পারব না আমি। শীঘ্রই দিল্লি যাব, রাজ্যসভার চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেব। রাজনীতি থেকে সরে আসব পুরোপুরি। দয়া করে কিছু করুন রাজ্যকে বাঁচাতে। শুভ কামনা রইল’।
আরও পড়ুন: Jawhar Sircar Resignation: রাজ্যসভার পদ ছাড়লেন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে সিদ্ধান্ত