কলকাতা: কলকাতা ফুটবলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ বলতে তিনটিই, এক, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, দুই, ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান ও তিন মোহনবাগান-মহমেডান। তিন প্রধানের ফুটবল যুদ্ধ (Kolkata Derby) নিয়ে সারা বাংলা, ভারতে চর্চা হয়েছে যুগযুগ ধরে।
ইস্টবেঙ্গলের (East Bengal) প্রায় তিন দশক আগে কলকাতা ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হয় মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব (Mohammedan Sporting,)। ১৮৯১-এ প্রতিষ্ঠিত মহমেডান এসসি-ই ইংরেজ আমলে প্রথম ভারতীয় ক্লাব, যারা কলকাতা ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৩৪-এ যখন তারা প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, তখনও ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান, কোনও ক্লাবই সেই খেতাব অর্জন করতে পারেনি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত শুধু একবার (১৯৩৯) বাদ দিয়ে প্রতি মরশুমেই কলকাতা লিগের খেতাব জেতে মহমেডান। তার পর থেকেই শহরের অন্য দুই প্রধানের সঙ্গে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা।
ইস্টবেঙ্গলের রমরমা শুরু হয় চল্লিশের দশকে। ১৯৪২-এ তারা প্রথম কলকাতা লিগ খেতাব জেতে। সেই থেকেই মহমেডানের সঙ্গে তাদের দ্বৈরথ। অর্থাৎ, দুই দলের মধ্যে লড়াই প্রায় ৯০ বছরের। প্রায় ৯০ বছর পুরনো সেই দ্বৈরথ গত কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ফের দেখা যাবে শনিবার, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে, যখন দুই দল মুখোমুখি হবে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের কলকাতা ডার্বিতে।
এ বারেই প্রথম আইএসএলে খেলা মহমেডান এসসি শুরুটা আশা জাগিয়ে করলেও গত তিন ম্যাচে হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। প্রথম তিন ম্যাচে চার পয়েন্ট অর্জন করে তারা, গতবারের আই লিগ জিতে উঠে আসা দল হিসেবে যা ছিল অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তার পরের তিন ম্যাচে যে ভাবে ন’গোল খায় সাদা-কালো ব্রিগেড, তাও কম অভাবনীয় ছিল না।
শেষ ম্যাচে হায়দরাবাদ এফসি-র কাছে মহমেডানের চার গোল খাওয়াটা ছিল রীতিমতো চমক। সাম্প্রতিককালে এত বড় ব্যবধানে জয় পায়নি হায়দরাবাদ এফসি। এই জয় পেয়ে লিগের দৌড়ে বেশ কিছুটা অক্সিজেন পেয়ে যায় তার আগের চারটি ম্যাচের একটিতেও জয় না পাওয়া নিজামের শহরের দল। এই জয় থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই বৃহস্পতিবার তারা চলতি লিগের দ্বিতীয় জয় অর্জন করে নেয় কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে।
অন্য দিকে, ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স আরও অপ্রত্যাশিত। মহমেডান তবু ছ’টি ম্যাচ খেলে চার পয়েন্ট পেয়েছে। লাল-হলুদ শিবিরের ভাঁড়ার সেখানে শূন্য। এই ছয় রাউন্ডে মহমেডান যেখানে তিন গোল দিয়ে ১১ গোল খেয়েছে, সেখানে চার গোল দিয়ে ১২ গোল হজম করেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতার দুই দল রয়েছে লিগ টেবলের একেবারে নীচের দুই স্থানে। শনিবার যুবভারতীতে লড়াই এই দুই দলের মধ্যেই।
আইএসএলে মাত্র চারটি গোল করে ইতিমধ্যেই ১২টি গোল হজম করা হয়ে গিয়েছে লাল-হলুদ বাহিনীর। শুধু প্রথম ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচেই অন্তত দু’টি করে গোল খেয়েছে তারা। কিন্তু সাম্প্রতিক এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে ছবিটা পাল্টাতে শুরু করেছে। ভুটানে টানা তিনটি ম্যাচে অপরাজিত থেকে (একটি ড্র, দুটি জয়) এশীয় স্তরের এই টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বে পৌঁছনোর পরে সমর্থকেরা অনেকেই আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেরই মনে হচ্ছে ভুটানের পারফরম্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আইএসএলের পরের ম্যাচগুলিতে। নতুন কোচ অস্কার ব্রুজোনও তা-ই চান।
অস্কার যে ভাবে গোটা দলটার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করেন, যে ভাবে দলের ছেলেদের বোঝান, খারাপ সময় সবারই আসে, ঠাণ্ডা মাথায় পরিশ্রম করলে ও ধৈর্য্য ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে গেলে খারাপ সময়ের পর ভাল সময় আসবেই। যে ভাবে ভুলগুলো শোধরানোর উপায় বাতলে প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা অনুযায়ী নিজেদের রণনীতি তৈরি করেন তিনি, তা প্রশংসার যোগ্য। এই ভাবে তিনি দলকে আইএসএলের আসরেও লড়াইয়ে ফেরাতে পারবেন কি না, সেটাই দেখার।
তবে অস্কারের এই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই থেকে প্রেরণা খুঁজে নিতে পারেন মহমেডান কোচ আন্দ্রেই চেরনিশভ। এই ম্যাচের আগে তাঁর শিবির প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি পেয়েছে এবং তরতাজা হয়ে ফের মাঠে নামবে তারা। এই অবকাশ কতটা কাজে লাগাতে পেরেছেন চেরনিশভ, তা এই ম্যাচেই বোঝা যাবে। তাঁর দলের নির্ভরযোগ্য ঘানাইয়ান ডিফেন্ডার জোসেফ আজেই চোটের কারণে এই ম্যাচেও অনিশ্চিত। গত তিন ম্যাচে ন’গোল খাওয়ার পর গোলকিপার পদম ছেত্রীকে হয়তো এই ম্যাচে বসতে হতে পারে।
আজেইয়ের অনুপস্থিতিতে গত ম্যাচে মহমেডান রক্ষণ কার্যত মুখ থুবরে পড়েছিল। ফরাসী ডিফেন্ডার ফ্লোরেন্ট অগিয়ে সে দিন নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। দু’সপ্তাহ পর ছবিটা পাল্টাতে পারবেন কি না অগিয়ে, তা এই ম্যাচেই বোঝা যাবে। দলের দুই ম্যাচে লাতিন অ্যাটাকার কার্লোস ফ্রাঙ্কা ও অ্যালেক্সি গোমেজের সমস্যা ধারাবাহিকতার অভাব। কোনও ম্যাচে তাঁরা ভাল খেলছেন, কোনও ম্যাচে খেলতে পারছেন না। দুই তারকা একসঙ্গে ভাল খেললে যে যেকোনও প্রতিপক্ষকেই সমস্যায় ফেলতে পারেন তাঁরা, তা এর আগে দেখা গিয়েছে। শনিবার বড় ম্যাচে এই দুই বিদেশীর ভাল খেলার দিকে তাকিয়ে থাকবেন সমর্থকেরা।
ইস্টবেঙ্গলের গ্রিক তারকা দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস গোলে ফিরে এসেছেন, এটাই লাল-হলুদ শিবিরের কাছে সবচেয়ে ভাল খবর। তাঁকে সাহায্য করার জন্য মাদি তালাল তো রয়েছেনই। সল ক্রেসপো, নন্দকুমার শেকর, পিভি বিষ্ণু-রা যদি তাঁকে যথাযথ সাহায্য করতে পারেন, তা হলে যে তাঁরা ইতিবাচক ফল পেতে পারে, তার প্রমাণ ভুটানেই পাওয়া গিয়েছে। দল হিসেবে খেলা ওখানেই শুরু করেছে তারা। তা বজায় রাখতে পারবে কি না লাল-হলুদ বাহিনী, এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
নাওরেম মহেশ সিং চোট সারিয়ে মাঠে ফিরবেন কি না, রক্ষণে ফর্মে না থাকা ডিফেন্ডার হিজাজি মাহেরকে প্রথম দলে রেখে খেলাবেন কি না অস্কার, এগুলো দেখার। সেন্টার ব্যাক হিসেবে আনোয়ার আলির সঙ্গে জিকসন সিংকে দেখা গিয়েছে তাদের অনুশীলন ম্যাচে। এই কম্বিনেশনও পরখ করে দেখতে পারেন লাল-হলুদ কোচ।
মহমেডানের আক্রমণ বিভাগ শক্তিশালী হলেও রক্ষণ একেবারেই মজবুত নয়। এই দুর্বলতা যেভাবে কাজে লাগিয়েছিল হায়দরাবাদ এফসি, সেই কাজে লাগাতে পারে ইস্টবেঙ্গলও। তবে গত দু’সপ্তাহে অনুশীলনে এই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে কি না সাদা-কালো বাহিনী, তা শনিবারের ম্যাচে বোঝধা যাবে। ইস্টবেঙ্গলেও রক্ষণের সমস্যা রয়েছে। ফলে নতুন কম্বিনেশন খুঁজতে হচ্ছে কোচকে। অর্থাৎ, শনিবার ডার্বিতে দেখা যাবে দুই দলের আক্রমণের লড়াই। গোলও হতে পারে অনেক। সত্যিই তা হলে মনোরঞ্জনের অভাব হবে না দর্শকদের।
আইএসএলে কোনও দলের বিরুদ্ধে প্রথম মুখোমুখিতে গত ছ’টি ম্যাচের একটিতেও হারেনি ইস্টবেঙ্গল এফসি। দুটি ম্যাচে জয় পেয়েছে তারা ও চারটিতে ড্র করেছে। শনিবার হোম ম্যাচ খেলতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল। গত দু’টি হোম ম্যাচে হেরেছে তারা। এই মরশুমে ফাইনাল থার্ডে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা ৬৮.২%নিখুঁত পাস দিয়েছে, যা অন্য যে কোনও দলের চেয়ে বেশি। এই অঞ্চলে তারা প্রতি ম্যাচে গড়ে ১১৫.৭টি করে পাস খেলেছে, যা চলতি লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, এফসি গোয়ার পরেই।
মহমেডান এ পর্যন্ত তাদের দু’টি অ্যাওয়ে ম্যাচের মধ্যে একটিতে জিতেছে, একটিতে হেরেছে। শনিবার তারা ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারলে আইএসএলে তারা হবে তৃতীয় দল যারা তাদের প্রথম তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচের মধ্যে দু’টিতেই জিতেছে। চলতি লিগে হেডে সবচেয়ে বেশি (৫) গোল হয়েছে মহমেডানের বিরুদ্ধেই। ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটে সবচেয়ে বেশি (৪) গোলও খেয়েছে মহমেডানই।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: