সেলিম রেজা, ঢাকা: কংক্রিটের ভাঙা দেয়াল, টিনের চালা, উপড়ে ফেলা বাঁশ-খুটি সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঢাকার খিলক্ষেত রেলগেট থেকে শুরু করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচ হয়ে পূর্বাচল তিনশ ফুট সড়কের প্রবেশ দ্বারের আগে খেলার মাঠ পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গাজুড়ে আশপাশের সব অবৈধ স্থাপনা এস্কেভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সরকারি জমি থেকে অবৈধ কাঠামো উচ্ছেদ অভিযানের পরের দৃশ্য এটি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেল লাইনের পাশ ঘেঁষে অস্থায়ী দোকানগুলোর পাশাপাশি সম্প্রতি কয়েকটি আধা পাকা কাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছিল। যেখানে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে কার্যালয়ও চালু করা হয়। এছাড়া দুর্গাপূজো আয়োজনে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওই এলাকায় তৈরি করা হয় একটি অস্থায়ী মন্ডপও। যেটিকে একটি ‘অস্থায়ী মন্দির’ হিসেবে সেখানে ধর্মীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন পূজোর আয়োজকেরা।
বৃহস্পতিবার থেকেই বাংলাদেশ জুড়ে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে এই অভিযান। যার মূলে ওই জমিতে তৈরি করা অস্থায়ী দুর্গা মন্দিরটি। যেটি অভিযানের সময় উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এই আলোচনার শুরু হয় আরো দুদিন আগে, যেদিন ‘স্থানীয় মুসল্লি’ নামে কিছু মানুষ ঐ অস্থায়ী মন্দিরটি উচ্ছেদের আল্টিমেটাম দেয়।
গত বছরের দুর্গাপূজোর সময় এই মণ্ডপটি ঘিরে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যার নাম ‘খিলক্ষেত সার্বজনীন দুর্গাপূজো মন্দির কমিটি’। সেবছরই প্রথমবারের মতো সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। ওই কমিটির দাবি, বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই সরকারি জমিতে অস্থায়ী পূজো মণ্ডপ করেছিলেন তারা। কিন্তু কোনো আগাম নোটিশ না দিয়েই মণ্ডপটি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
তারা বলছে, “মন্দিরে ঠাকুরের প্রতিমা ছিল, সেগুলো সহ উচ্ছেদ হয়েছে, আগে থেকে জানালে প্রতিমাগুলো সরাতে পারতাম আমরা। মায়ের প্রতিমা কেন উচ্ছেদ হল।”
যদিও বাংলাদেশ রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মৌখিকভাবে জানালেই চলে, লিখিত নোটিশের প্রয়োজন নেই। এছাড়া মন্দিরটি ঘিরে ওই এলাকায় মব তৈরির শঙ্কা ছিল বলেও জানান বাংলাদেশের রেলের মহাপরিচালক।
মন্দির উচ্ছেদের এই ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজো উদযাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। যদিও বাংলাদেশের রেলের সরকারি জমিতে মন্দিরের অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশের পর ‘ফ্যাক্ট’ বা ঘটনা তুলে ধরে একটি বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। বিবৃতিতে বলা হয়, “সকলের প্রতি অনুরোধ, কেউ যেন প্রকৃত তথ্য ও বাস্তবতা যাচাই না করে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানায়,”। অবশ্য বাংলাদেশ রেলওয়ের এই অভিযানে মন্দিরটি ছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করছেন অনেকে।
এমনই একজন চা বিক্রেতা মোহাম্মদ মাসুদ জি ২৪ ঘন্টাকে বলছিলেন, “আগে থেইকা কিছুই কয় নাই, বুলডোজার আইনা কয় সব অহনই সরাও।” আগাম নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ উচ্ছেদ করায় বিপাকে পড়েছেন বলে জানান ওই এলাকার আরো কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, “প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই সরাতে না পারায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় মন্দির উচ্ছেদের ভিডিওটি। যেখানে দেখা যায়, পুলিস ও রেল পুলিসের সদস্যদের সহায়তায় এস্কেভেটর দিয়ে উচ্ছেদ হচ্ছে মন্দিরের কাঠামো। মন্দিরটির ভেতরেই ছিল বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি।
আরও পড়ুন-ছেলের ‘কীর্তি’ শুনে বিস্ফোরক মনোজিতের মা…
আরও পড়ুন-ঢাকায় ভাঙা হল দুর্গামন্দির! ভারত কড়া হতেই ইউনূসের পালটা দাবি, মূর্তিকে…
জানা যায়, গত ২৪শে জুন রাতে ‘স্থানীয় জনতা’ পরিচয়ে কয়েকশ মানুষ মন্দিরটি সরিয়ে নিতে বিক্ষোভ করেন। পরদিন বেলা ২টার মধ্যে মন্দিরটি সরিয়ে নিতে আল্টিমেটাম দেন তারা। পরে ২৬শে জুন রেলওয়ে কর্মকর্তাসহ বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বুলডোজার দিয়ে স্থাপনাটি উচ্ছেদ করে। একই সাথে উচ্ছেদ করা হয় ওই এলাকায় রেল লাইনের পাশ দিয়ে গড়ে তোলা অনেক অবৈধ স্থাপনাও।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক সজিব সরকার জি ২৪ ঘন্টার বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে বলেন, পুলিস, র্যাব, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য বুলডোজার দিয়ে মন্দিরের কাঠামো উচ্ছেদ করে ফেলে। তিনি বলেন, পূজো আয়োজন করতে গত বছর বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরির লিখিত অনুমতি নিয়েছিলেন তারা। তবে মন্দির গড়ে তোলার কোনো অনুমতি তাদের ছিল না।
ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির উচ্ছেদের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে আলোচনা সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার ছবি কিংবা ভিডিও দিয়ে নানা মতামত তুলে ধরছেন।
বাংলাদেশ পূজো উদযাপন পরিষদ ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ঢাকার এই ঘটনা এবং সম্প্রতি বাংলাদেশের লালমনিরহাটসহ কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)