সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁকে সনাক্ত করেছিলেন, দ্য আউটসাইডার অভিধায়। বাঙালির বাজারের থলি হাতের নুব্জতা, দিনান্তের ফিয়ার্স লেনের এঁটো থালা, মুক্ত অর্থনীতির ক্লীব জননাঙ্গহীনতা, ডিশ অ্যান্টেনাওয়ালা ছাদ ও ভোটসর্বস্ব চ্যাটচ্যাটে সুবিধেবাদী ধান্দাবাজি’র মাঝে বড় বেমানান ছিল তাঁর কেদার বোস লেনে ঢুকে পড়া। সমর সেন তাঁকে নিষেধ করেছিলেন ফিরে আসতে। তাঁর পিতৃদেব বলেছিলেন, ‘সংগীত কে পেশা করলে মানুষ দুঃখ দেয়’। অদূরে বহু নৃশংস দাঁত-নখ যুক্ত অপবাদেরা মুখ চেপে হেসেছিলো। শয়তানি হাসি। ঈশ্বর তখন বলতে পারেননি, বাঘকে একা বাঁচতে হয়, গহীন অরণ্যে। যে বাঘের গিটার শায়িত এক সভ্যতার জরায়ু প্রদেশে আনুভূমিক-তার উপর দিয়ে, হাসছে, কাঁদছে, বাঁচছে, মরছে, প্রেম করছে, রাস্তা করছে চাকরি করছে, যুদ্ধকরছে, ফুল ফোটাচ্ছে দু’শ বছর পরের সভ্যতা- যাদের সবার ধর্ম কবীর- যাদের সমাজ অর্থনীতি, ব্যক্তিগত, রাজনীতি, সন্তান, জীবিকা সবকিছুর নাম-হ্যাঁ, কবীর । ক্রমে আমারও কোষে-তন্তুতে-স্নায়ুমন্ডলে জারিত হলেন তিনি। সবার যেভাবে হয়েছে কতকটা সেভাবেই। অবচেতনের ‘ভাবনার ভঙ্গীতে’ সঞ্চারিত হলেন ক্রমে আকণ্ঠ মদ্যপানের মতো। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ’র ভাই যেভাবে আয়নায় নিজেকে দেখার আছিলায় চে’গেভেরাকে অনুভব করত, আমিও বাঁচতে বাঁচতে বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে করতে থাকলাম আমিই কবীর! কিন্তু, এ তো আমার ব্যক্তিগত আবেগ; কবীর নামক মহাসমুদ্রের পাশে বসে দিনের পর দিন সময় যাপনের এক নৈশ উপখ্যান।
Zee ২৪ ঘণ্টার সব খবরের আপডেটে চোখ রাখুন। ফলো করুন Google News
আমার সহজ চোখে তাকিয়ে থাকা। এই দিয়ে তো শিল্পীসত্তার relevance ব্যক্ত হয় না! সুরেরও গভীর সুরে যে পদাবলীর চরণ ছিল, ছিল মণীষা, প্রজ্ঞা’র তুরীয়তা, ছিল অমানুষিক অধ্যাবসায় ও ঋজুতা, ছিল স্বতন্ত্র উচ্চারণ নির্মাণ, ছিল একাধিক শব্দ গণচৈতন্যে ভরে দেওয়া (যেমন- ‘সহনাগরিক’, ‘বন্ধুতা’) ছিল স্বতন্ত্র Sound নির্মাণ, মৌলিক শৈলী উদ্ভাবন, একরৈখিক ইতিহাসের ধান্দাবাজিকে প্রশ্ন করে রামায়ণকে বিনির্মাণ করা, গর্জে ওঠা হিন্দি ভাষার রাষ্ট্রমতবাদের বিরুদ্ধে, শিবসেনার বি আর আম্বেদকরের গলায় জুতোর মালা পরানোর বিরুদ্ধে, ছিল একইসাথে নানা ভাষার মনন বিনিময় করতে করতে হারমোনিকাকে ঠোঁটে নিয়ন্ত্রণ ও দু-হাতে কি-বোর্ডস ও গিটার সামলানো, আচমকা চেঁচিয়ে ওঠা বেদম খিস্তির পবিত্রতায়, আবার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সজীব কোমলতা পরক্ষণেই, ছিল একটা আশ্চর্য unpredictability, মুহূর্তকথা বলতে বলতে বিমূর্ত মহাসাগরের গভীরতম প্রদেশে পৌঁছে যাওয়া, ছিলেন সঞ্জীব পুরোহিত, গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস, উলফ বিয়ারমান, বিলায়েত খাঁ, ছিল পাল্টে যাওয়া চেনামুখের দ্যাখন হাসি, গড়িয়ার খাল দিয়ে ভেসে যাওয়া লখিন্দর ছিল ফড়িংয়ের ডানা, ছিলেন অরুণ মিত্র-বেগম রোকেয়া-সুফিয়া কামাল-ইলিয়াস-অজম খান-মহমুদন্নবী-ছিল গোরা কোরান ছিল-প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টারভিউ-ছিল সেকুলার মুসলিমিজম-ছিল নিজের মাটিতে দাঁড়ালে কিছু হাত ওই হাত ধরে তার বিশ্বাস-ছিল দাবীর নিশান হয়ে দুলে ওঠা-ছিল কর্ণ নামক ছোট্ট ছেলেটি-ছিল ফড়িং’র ডানা-ক্লাস পালানো ঝিলপাড়-ছিল রাগে ফেটে না পড়ার কারণ তোমার ভণ্ডামি-ছিল।
সংবাদ শিল্প জীবন কাব্য নামগোত্র কাম হিসেব নিকেশ চৌকাঠ ভেঙে চুরমার-ছিল তোমায় ছাড়া বাঁচা আসলে সুড়ঙ্গে ফেরার খুনির বাঁচার ধরণ-ছিল ইতিহাস ও কাব্যের হাত ধরাধরি করে হাঁটা-রক্তমাংসের পথ দিয়ে -যে হাঁটায় তিনি মঞ্চ থেকে কী-বোর্ডের দিকে হেঁটে গেলে অলোকরঞ্জন সেই হাঁটার নাম দেন, ‘ধর্মের মতো হাঁটা’- ছিল সশরীরে টাটকা যুদ্ধ দেখা ও মানব মিত্রের ‘মুক্ত নিকরাগুয়া’- ছিল ‘Disvovering The other America’-র বিকল্প আমারিকার চিন্তকদের সাক্ষাৎকার-ছিল আবহমান বাংলার সংগীত সাধকদের ইতিবৃত্ত হয়ে ওঠা গানের সন্নিবেশে, ছিল বেঁচে নেওয়া-বারবার সবকিছুকে রিজেক্ট করে বেঁচে নেওয়া আর বেঁচে নেওয়া- অচেনায় যাওয়া–পোষ না মানা–ছিল ‘তোমাকে চাই’র জন্য চল্লিশ হাজার টাকা অর্চনা গুহকে দিয়ে দেওয়া–ছিল কানরিয়া জুটমিলের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’-ছিল একের পর এক পারিশ্রমিক ছাড়াই অনুষ্ঠান করে দেওয়া এর ওর তার জন্য-ঢাকার জাদু ঘরের নির্মাণের জন্য অনুষ্ঠানের সমস্ত পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়া-ছিল একের পর এক সংবাদপত্র ও সমাজের কামড় এবং তাঁর অসংখ্য সন্তানসন্ততির তাঁর পাশে পাশে থাকা ও কান্না-তারপর সকাল হতেই তানপুরার ওঁ এবং শ্রম শ্রম শ্রম ও একটিও প্রতিষ্ঠানের তা তুলে না ধরা, ছিল-‘বন্ধুরা, একটা মানুষকে মারতে যদি এতোগুলো প্রতিষ্ঠানের দরকার পড়ে, তবে আপনারা যদি সংগঠিত হন দেশ আরও উন্নত হবে’- ছিল সাগরময় ঘোষের প্রশ্রয়ে ‘দূরের জানলা’, ছিল বিনয় ঘোষের অভিভাবকত্ব, ছিল দুটি উপন্যাস-‘রীতিমত নভেল’ ও ‘৫২’, ছিল ‘হারবার্ট’ ছবির দেবী রায়-ছিল খিদে পাওয়া পাকস্থলী-আরও অসংখ্য বিমূর্ত অনুভূতি…
আরও পড়ুন: দেহদান নয়! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কবীর সুমনের…
(এ বাক্যটা চলছেই এরপর, হে পাঠক আপনি বরং পরের বাক্যবন্ধে তাকান, এদের চলতে দিন)
জনৈক দুই বুদ্ধিজীবের কথাবার্তা-
ব্যক্তি ১: তা হলে লোকটাকে একটা জনপ্রিয় চিহ্ন হিসেবেই খবরের কাগজগুলো দেখাল? কিন্তু ওঁর শ্রম, মেধা, কীভাবে সভ্যতাকে পুষ্ট করেছে অন্তর থেকে, তা নিয়ে আলোচনা নেই । এটাই কি হয়ে আসেনি বঙ্গস্তুতিকারদের ইতিহাসে?
ব্যক্তি ২: এ তো সবে ভগবান নির্মাণ শুরু হল। দুশো বছর যেতে দাও না। দেখবে যারা কামড়ে রক্তাক্ত করল সবচেয়ে বেশি, তারাও কত শোকপীড়িত, বিহ্বল…
ব্যক্তি ১: কেন এমন বলছ?
ব্যক্তি ২: বাঙালি যাকেই খাঁচায় আটকাতে পারেনি তাকেই ঢিল ছুঁড়েছে। ভুলে যেওনা আমাদের বাপ-ঠাকুরদাই রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রকল্পকে মাগীবাজি বলেছিল। তারাই বিদ্যাসাগরকে মারতে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এরাই মধুসূদন-মানিক-ঋত্বিকদের reject করেছে, অন্যদিকে তাঁদের মৃত্যু হতে না হতেই নিয়মিত মালাও পরিয়েছে । আমরা তো রাধাকান্ত দেবের বংশধর তাই নয় কি?
ব্যক্তি ১: তা তো ঠিকই, নয়তো যে মানুষটা হাজার হাজার সংগীত উপহার দেন একটা জাতিকে, দেন সচেতনতা, নানাবিধ বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে, তাঁকেও নোংরা অশ্লীল খিস্তি করা হয় বার বার? লোকটা যে জিনিয়াস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে…
ব্যক্তি ২: এই তোমার ‘তবে’ টাই একজন সক্রেটিসকে তাঁর সমকালে মেরেছে। মেরেছে একজন গ্যালিলিওকে। মেরেছে একজন রাসেলকে। মেরেছে আরও অজস্র মহামানুষকে-যাকে দেখেছে গড় থেকে একটু লম্বাটে, তাকেই বলেছে, ‘মার শালাকে’। ক্ষমতার এই মারে যারা মৃত তারা দেখ কেমন ‘লোকসংখ্যা’ হয়ে জ্বলজ্বল করছে আকাশে।
(পুনর্মুদ্রিত। সংক্ষেপিত। বানান অপরিবর্তিত)
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)