প্রাক্তন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। প্রদেশ কংগ্রেসের নয়া সভাপতি হলেন শুভঙ্কর সরকার। তাঁর আমলে রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের সমীকরণ কী হবে, সেই নিয়ে প্রশ্ন ঘুরছে। সেই আবহে এবিপি আনন্দকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন শুভঙ্কর। (Subhankar Sarkar Exclusive)
প্রশ্ন: প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হবেন প্রত্যাশা ছিল কি?
উত্তর: আজ সকাল থেকে যাঁরা ফুল নিয়ে আসছেন, কাল যখন নাম ঘোষণা হয়, রাত ১-টা দেড়টা পর্যন্ত বাজনা বাজান কেউ কেউ। সকলকে একটাই কথা বলি, কলকাতা এবং বাংলা এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এই সময় কোনও বাজনা, উচ্ছ্বাস, আবিরখেলা বা উচ্ছ্বাস নয়। এটা আমাদের দলীয় রদবদল। একজন সভাপতি ছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে, নিয়ম অনুযায়ী থাকতে হয়, চলে যেতে হয় একসময়। আজ আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে। আগামী দিনে, নির্দিষ্ট সময়ের পর আমাকে এই পদ থেকে চলে যেতে হবে।
প্রশ্ন: এমন সময়ে দায়িত্ব নিলেন দলের, সাংসদ সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে, আগেই শূন্য হয়ে গিয়েছে। কী কৌশল নিয়ে চলবেন আপনি?
উত্তর: কর্মীদের কথা মাথায় রেখে, তাঁদের যে ভাবনা, নেতাদের যে চিন্তা ধারা এবং বাংলার মানুষের যে প্রত্যাশা, এগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক ভাবে চলতে পারলে, নিশ্চিত ভাবে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াবে। এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই আমার।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, অধীর চৌধুরী তৃণমূলের প্রবল বিরোধিতা করছিলেন। সেই তুলনায় তৃণমূলের প্রতি অনেক নরম শুভঙ্কর। রাজ্য রাজনীতি শুধু নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতির দিকে নজর রেখে শুভঙ্করকে বসানো যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ এই সময়। আপনার সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক তাহলে কী হবে। আপনি কি সত্যিই তৃণমূলের প্রতি নরম?
উত্তর: কট্টর-নরম জানি না। মানুষের চাহিদাই আমার কাছে প্রাধান্য পাবে। মানুষ যা চাইছেন, সেদিকেই আমাদের দলকে চালিত করতে হবে। তৃণমূল আমার কাছে একটি রাজনৈতিক দল। তারা যদি সঠিক ভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে আমি অহেতুক তৃণমূলের বিরোধিতা করব না। আমার দলের কথা নিশ্চিত ভাবে বলব। কাল যদি কোনও কারখানা গড়ে ওঠে, বাংলার শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে, আমি নিশ্চিত ভাবে সরকারকে সমর্থন করব। কিন্তু সেই শিল্প তৈরি করতে গিয়ে তৃণমূলের লোকেরা যদি চাঁদা তোলেন, তার বিরোধিতা করব। আমরা গতদিন পর্যন্ত বামেদের সঙ্গে ছিলাম। বামেদের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে প্রচার করেছি। আমি আজ সভাপতি হয়েছি। আমি যদি এখনই বলে দিই, বামেদের সঙ্গে নেই, তৃণমূলের সঙ্গে আছি, বা তৃণমূলের সঙ্গে নেই, বামেদের সঙ্গে নেই…আমাকে এই জন্য সভাপতি করা হয়নি। আমাকে সভাপতি করা হয়েছে কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে।
কাল ধরুন বাংলায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হল, যেখানে নাগরিক সমাজ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এই নাগরিক সমাজের বাইরে গিয়ে আমার কিছু কথা বলার থাকবে? থাকবে না। নাগরিক সমাজের সঙ্গেই যেতে হবে আমাকে। অতএব মানুষকে নিয়ে কাজ করতে চাইলে, মানুষ কী ভাবছেন, কী বলছেন, বিষয়টি একেবারে নীচ থেকে জানব আমরা।
প্রশ্ন: সেক্ষেত্রে কি তৃণমূলের সঙ্গেও সমঝোতার পথ খোলা থাকবে?
উত্তর: এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমরা সর্বভারতীয় দল। দল যদি চায়, আমার উপর য়এ নির্দেশ আসবে, আমাদের কর্মনীদের কথাও বলব। এখনও পর্যন্ত বামেদের সঙ্গে জোট গড়ে নির্বাচনে লড়াই করেছিলাম। বামেরা আমাদের I.N.D.I.A জোটের শরিক ছিল, আবার তৃণমূলও শরিক।
প্রশ্ন: প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীকে কী ভাবে মূল্যায়ন করবেন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে?
উত্তর: আমি মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে একটাই কথা বলব, মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়ে জোর দিন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে দুর্নীতির প্রশ্ন আসছে, এটা স্বচ্ছতার সঙ্গে মানুষের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর তুলে ধরা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেত্রী হিসেবে কী ভাবে দেখেন?
উত্তর: স্ট্রিট ফাইটার থেকে একসময় মানুষকে স্টেটসম্যান হতে হয়। স্টেসসম্যান হওয়ার যে ক্ষমতা বা যোগ্যতা, সেটা এখনও পর্যন্ত বিধান রায়ের মতো অর্জন করার ক্ষেত্রে তাঁকে আরও সময় ব্যয় করতে হবে। কারণ আর জি করের এই মেয়েটির মৃত্যু, নিছক মৃত্যু নয়। কোনও একজনকেও আড়াল করবেন না।
প্রশ্ন: রাজ্যে আপনাদের মূল প্রতিপক্ষ কে, বিজেপি না তৃণমূল?
উত্তর: আমরা সমভাবে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন: অধীর দেশের বিরোধী দলনেতা ছিলেন, বহুবার সাংসদ হয়েছে। আপনি ব্যাটন তুলে নিলেন। এটাকে কঠিন মানছেন?
উত্তর: আরে, অধীরদা তো আমার দলের নেতা। তাঁর জায়গায় আমি এসেছি। আমি মনে করি, অধীরদা পদ থেকে গিয়েছেন, নেতৃত্ব এবং তাঁর উপদেশ থেকে যাননি।
প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্বে শুভঙ্করের নিযুক্তিতে রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অধীরের মতো তিনি তৃণমূলের বিরোধিতা করবেন, না কি সুসম্পর্ক রেখে চলবেন, সেই প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনই এ নিয়ে বামেদের প্রতিক্রিয়া নিয়েও কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তাই গোটা বিষয়টি নিয়ে বামেরা কী ভাবছে, তা জানতে চাওয়া হয় সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কাছে। তিনি বলেন, “জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় একটা দল। তারা কী ভাবে দল চালাবে, কাকে সভাপতি করবে, এসবের থেষ্ট যোগ্য তারা, নিজেরা ঠিক করতে পারবে। আমাদের এ নিয়ে বেশি ভাবনা, বেশি মত দেওয়া, দুশ্চিন্তা করা বা উল্লসিত হওয়া কাজের মধ্যে পড়ে না। এটা নীতির প্রশ্ন, ব্যক্তির চেয়ে রাজনীতিতে, দলের কাছে নীতির প্রশ্ন বেশি প্রাধান্য পায়। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কংগ্রেস নেতারা চলেন। ব্যক্তির উপর কিছুই নির্ভর করে না যেমন ঠিক নয়, তেমনই ব্যক্তির উপর সবকিছু নির্ভর করে না। আমরা বিজেপি-র বিরুদ্ধে সকলকে একজোট করে লড়াইয়ের চেষ্টা করি। সবাই জানেন বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমরা। এ রাজ্যে কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা জানেন, বিজেপি-র সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করেই কংগ্রেসকে টিকে থাকতে হয়। তাঁরা আমাদের চেয়ে এটা কম বোঝেন না। নিশ্চয়ই তাঁদের নেতৃত্ব এটা বুঝে চলবেন।”
কিন্তু আগামী দিনে যদি প্রদেশ কংগ্রেস শুভঙ্করের নেতৃত্বে তৃণমূলের প্রতি কট্টরপন্থী অবস্থান থেকে সরে এল, সেক্ষেত্রে কী বাম-কংগ্রেস সমীকরণ পাল্টাবে? সুজনের যুক্তি, “শুভঙ্কর সরকার কেন যে কারও নেতৃত্বে কেউ মনোভাব পাল্টালে, আমাদের মনোভাব পাল্টাতে হবে এমন নয়। আমরা স্বাধীন ভাবেই চলেছি, কারণ যুক্তিটা সঠিক। ফলে কংগ্রেস সমর্থকরা মনে করেছেন আজকের তৃণমূল কালকের বিজেপি। তাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইটা জরুরি। কংগ্রেরে কর্মী-সমর্থক এবং হাইকম্যান্ডের উপর বিশ্বাস রেখে চলা উচিত। বাকিটা সময় ঠিক করে দেবে।” (West Bengal Congress Chief)