নয়াদিল্লি: তদন্তভার আগেই গেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা CBI-এর হাতে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নিরাপত্তাও গেল কেন্দ্রীয় বাহিনী CISF-এর হাতে। আর জি কর-কাণ্ডের তদন্ত নিয়ে কলকাতা পুলিশের ওপর আস্থা রাখেনি কলকাতা হাইকোর্ট। নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখল না সুপ্রিম কোর্টও। তরুণী চিকিৎসার হত্যাকে কেন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হল, এই প্রশ্নও তুলেছে শীর্ষ আদালত। কেন দেরিতে FIR দায়ের হল, হাসপাতালে বহিরাগতরা ঢুকে পড়ে তাণ্ডব চালাল কী করে, পুলিশ কেন পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হল, রাজ্যকে তীব্র ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি, তদন্ত নিয়ে ২২ অগাস্টের মধ্যে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে CBI-এর কাছেও। (Supreme Court on RG Kar)
আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে শীর্ষ আদালত। মঙ্গলবার সেই নিয়ে শুনানিতে প্রথম দিনই তিরষ্কৃত হয় রাজ্য। শুধুমাত্র কলকাতা বলেই নয়, গোটা দেশে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তায় ঢিলেমি নিয়ে প্রশ্ন তোলে আদালত। পদ্ধতিগত এই ত্রুটি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, “কলকাতার হাসপাতালে খুনের ওই ঘটনার জেরেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা গ্রহণ করিনি আমরা। দেশের সর্বত্র চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় যে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, এক্ষেত্রে সেই নিয়ে উদ্বেগের জায়গা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, বিশেষ করে মহিলা চিকিৎসকদের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা।” (RG Kar Supreme Court Hearing)
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানান, এই ব্যাপারে দেশ জুড়ে ঐক্যমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সর্বভারতীয় স্তরে শর্তাবলী থাকা প্রয়োজন। মেয়েরা যদি কাজের জায়গায় নিরাপদ অনুভব না করেন, এর অর্থ সমান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা। নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্তাবলীগুলি সঠিক ভাবে প্রয়োগের জন্য এখনই কিছু করা প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদে নিরাপত্তার জন্য এদিন ‘ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স’ও গঠন করে আদালত, যাতে দেশের সর্বত্র কোথায়, কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তার সুপারিশ করতে পারেন তাঁরা এবং সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি। মহারাষ্ট্র, কেরল, তেলঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে চিকিৎসকদের হিংসা থেকে বাঁচাতে আইন আনা হলেও, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নিরাপত্তায় ঘাটতি রয়েছে বলে জানায় আদালত।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পর্দিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চ জানায়, “জ্ঞান-বিজ্ঞানের কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি সংখ্যক মহিলারা যোগদান করছেন যখন, তাঁদের জন্য নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ কাজের পরিবেশ গজডে তোলায় দেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবিধানিক মূল্যবোধের মধ্যেই সাম্য নিহিত রয়েছে। তাই যাঁরা অন্যদের সেবায় নিযুক্ত, তাঁদের সুস্থতা এবং নিরাপত্তায় কোনও রকম আপস চলে না। এই পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে দেশ আর একটি ধর্ষণ বা খুনের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। “
আদালত যে যে উদ্বেগের জায়গাগুলি তুলে ধরেছে, সেগুলি হল-
- চিকিৎসা কর্মী, যাঁরা নাইট ডিউটি করেন, তাঁদের বিশ্রামের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। পৃথক ডিউটি রুমের ব্যবস্থা নেই পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য।
- ইন্টার্ন, আবাসিক এবং সিনিয়র আবাসিকদের ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করানো হচ্ছে। অথচ ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা, সাফ-সাফাইয়ের ব্যবস্থাও নেই।
- কোনও ব্যতিক্রমী বিষয় নয়, হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তারক্ষীর অভাব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
- চিকিৎসা কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।
- চিকিৎসা কর্মীদের থাকার জায়গায় হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে। আসা-যাওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যবস্থাও নেই যথেষ্ট।
- হাসপাতালগুলিতে নজরদারি চালাতে যথেষ্ট সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।
- রোগী এবং তাঁদের সহায়কদের সর্বত্র অবাধ বিচরণ।
- প্রবেশ কালে অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে কি না দেখার জন্য স্ক্রিনিংয়ের অভাব রয়েছে।
- হাসপাতালের বহু জায়গা অন্ধকার এবং আলো থাকলেও, তা টিমটিমে।
চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি তদারকির জন্য যে টাস্কফোর্স গঠন করেছে আদালত, তাতে নেতৃত্ব দেবেন ভারতীয় নৌবাহিনীর চিকিৎসা পরিষেবা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল, অ্যাডমিরাল আরতি সরিন। এ ছাড়াও টাস্ক ফোর্সে রয়েছেন প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডি নাগেশ্বর রেড্ডি, দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস়-এর ডিরেক্টর এম শ্রীনিবাস, বেঙ্গালুরুর NIMHANS-এর প্রতিমা মূর্তি, জোধপুর AIIMS-এর গোবর্ধন দত্ত পুরি, দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালের এস রাওয়ত, এশিয়া পেসিফিক পিডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি-ক উপাচার্য তথা অধ্যাপিকা অনিতা সাক্সেনা, জেজে গ্রুপ হাসপাতালের পল্লবী সাপলে এবং গুরুগ্রামের পারস হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন পদ্মা শ্রীবাস্তব।
চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত ওই টাস্ক ফোর্স নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নিজেদের মতামত জানাবেন, কী কী পদক্ষেপ করা যেতে পারে, তার সুপারিশ করবেন, যা গোটা দেশে কার্যকর করা হবে। টাইমলাইন ধরে, কোথায় কী করা যেতে পারে, তাও জানাতে পারে টাস্ক ফোর্স। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিতে হবে ওই টাস্ক ফোর্সকে। চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে আগামী দুই মাসের মধ্যে। সেই মতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত হাসপাতালকে পদক্ষেপ করতে হবে। কত সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত করতে হবে, প্রবেশপথে ব্যাগেজ স্ক্রিনিং, চিকিৎসকদের বিশ্রামের ঘর, হাসপাতাল জুড়ে সিসিটিভি, রোগীদের অনুযোগ সামাল দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ, হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ পোস্ট এবং যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে টাস্ক ফোর্সের নির্দেশানুসারে চলতে হবে হাসপাতালগুলিকে। সেই মতো এক মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে হলফনামা জমা দিতে হবে আদালতে।
আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কাজে ফিরতে অনুরোধ জানায় আদালত। আদালত জানায়, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আদালত। তাই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কাজে ফিরে যাওয়াই কাম্য। আদালত বলে, “দেশের সর্বত্র যাঁরা কর্মবিরতিতে রয়েছেন, তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব কাজে ফিরতে অনুরোধ করছি আমরা। দৈনন্দিন জীবনে সমাজের যে অংশের চিকিৎসা পরিষেবা প্রয়োজন, তাঁদের ওপর এই কর্মবিরতির প্রভাব পড়ছে। চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের আশ্বস্ত করছি, তাঁদের দাবিদাওয়া অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আদালত।”
আর জি কর কাণ্ডে এদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে আদালত। নির্যাতিতার নাম এবং ছবি এবং মৃতদেহের ভিডিও সংবাদমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে আদালত। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের বলে জানানো হয়। রাজ্য সরকারের হয়ে আদালেত সওয়াল করছিলেন বর্ষীয়ান আইনজীবী কপিল সিবল। তিনি জানান, পুলিশ পৌঁছনোর আগেই ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর জি করের সদ্য প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি, দেরিতে FIR দায়ের করা এবং ১৪ অগাস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ মিছিল চলাকালীন আর জি করে ভাঙচুরের ঘটনার নিন্দা করে আদালত। আদালত বলে, “ভোরবেলা অপরাধের ঘটনা সামনে আসার পরও অধ্যক্ষ আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। পরিবারকে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেহ দেখতেই দেওয়া হয়নি।” যদিও এতে আপত্তি জানান সিবল। তিনি জানান, ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য ঘটনাবলীর রেকর্ড তুলে ধরবে। কিন্তু তড়িঘড়ি সন্দীপকে অন্য হাসপাতালের দায়িত্বে বসানো হল কেন, প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। FIR দায়েরে দেরি হওয়া নিয়ে সিবল জানান, ঘটনার পর সঙ্গে সঙ্গেই ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র অভিযোগ দায়ের হয়। তাই অভিযোগ ঠিক নয়।
আর জি করের নির্যাতিতার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টে ৪৫ মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়। রাত ৮.৩০টা নাগাদ দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় শেষকৃত্যের জন্য। তার পর, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে কেন FIR দায়ের হল, প্রশ্ন করেন প্রধান বিচারপতি। হাসপাতালের কেউ কেন FIR দায়ের করালেন না? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী করছিলেন? ময়নাতদন্তে কি ধর্ষণ এবং খুনের কথা উঠে আসেনি? অধ্যক্ষ কী করছিলেন? কেন আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইছিলেন? জানতে চান তিনি। ১৪ অগাস্ট বহিরাগতদের ভিড় কীভাবে হামলা চালাল? পুলিশ কী করছিল? সেই প্রশ্নও তোলেন।
আদালতে এদিন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান, ৭০০০ মানুষের ভিড় জমেছিল। পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু জানত না, তা হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে এই মুহূর্তে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজীব কুমার। তাঁর বিরুদ্ধেও বহু অভিযোগ রয়েছে বলে জানান তুষার। এর প্রতিবাদ করেন রাজ্যের আইনজীবী সিবল। আর জি করের ঘটনায় শহর জুড়ে লাগাতার প্রতিবাদ, মিছিল চলছে, যা ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বেধেছে। সেই নিয়ে আদালত জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর বলপ্রয়োগ করা যাবে না। সংবেদনশীল হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে বলে জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে সিবল জানান, গোটা ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম, ভুয়ো তথ্য ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে CBI-কে বৃহস্পতিবারের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে আদালত।
আর জি করের নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের তরফে আদালতে চিঠি দেওয়া হয়। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করতে পারছেন না বলে জানান। এতে বিচারপতিরা জানান, রাজ্যের এই পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। এর পরই কেন্দ্রীয় বাহিনী নামাতে বলা হয়। আদালতের এই নির্দেশ নিয়ে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি সুকান্ত মজুমদার জানান, পুলিশের উপর আস্থা নেই বলেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাইছেন তাঁরা। কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি। যদিও তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের মতে, আদালত বিজ্ঞানসম্মত এবং ইতিবাচক রায় দিয়েছে। গোটা দেশে এই ধরনের অপরাধ ঘটে বলে জানানো হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতেই নির্দেশ এসেছে। গোটা দেশের জন্যই এই রায় স্বাগত বলে মন্তব্য করেন কুণাল। আর জি করে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর নির্দেশ আসেনি বলে এদিন দুপুর থেকে দাবি করছিলেন কুণাল। শুনানিতে আদালত একথা বললেও, লিখিত রায়ে তার উল্লেখ নেই বলে দাবি করেন। পরে সংযোজিত নির্দেশে CISF নামানোর কথাও তুলে ধরেন তিনি। এতে রাজ্যের আপত্তি নেই বলেও জানান।