আমিষ নিষিদ্ধের পক্ষে সওয়াল, তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়ালেন শত্রুঘ্ন, তীব্র প্রতিক্রিয়া
কলকাতা: আমিষ খাবার নিষিদ্ধের পক্ষে সওয়াল করে বিতর্কে তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা। এতদিন যে নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বকে বার বার আক্রমণ করে আসছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব, তাঁদের সাংসদ এমন মন্তব্য করলেন কী করে, উঠছে প্রশ্ন। দলের উল্টো রাস্তায় হাঁটা শত্রুঘ্নের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করবে তৃণমূল, সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিভিন্ন মহলের মানুষজনেরাও শত্রুঘ্নের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। (Shatrughan Sinha Nonveg Ban Remarks)
শত্রুঘ্নর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার। তাঁর বক্তব্য, “ওঁর খাদ্য উনি কী খাবেন, সেটা ওঁর ব্যাপার। সর্বভারতীয় স্তরে আমিষ খাবার নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কিছু মুষ্টিমেয় লোকের এমন পরিকল্পনা থাকলেও, সেটা করা অসম্ভব। কারণ দেশের ৭৮ শতাংশ লোক আমিষ খান। এটা করা যায়না। এটা সংবিধান বিরোধী। সংবিধানে যে অধিকার রয়েছে, তাতে এটি রয়েছে। শুধু বাঙালি হিসেবে নয়, ভারতীয় হিসেবে বলব, কে কী খাবেন, তা নিয়ে কারও কিছু বলার অধিকার নেই।” (TMC News)
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “শত্রুঘ্ন সিনহার নিজের মত হতে পারে। আমি যদিও বহুদিন ধরে নিরামিষ খাই। কিন্তু দেশবাসী নিরামিষ খাবে, এমন ফরমান দেওয়ার অধিকার নেই আমার। অনেকেই আছেন, যাঁরা মাছ-মাংসটাই খান। আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া, খাওয়া চলবে না, বলা যায় না। মা কালী তো মাছ খায়, মাছ খেতে ভালবাসেন। বাংলায় তাই মাছের প্রচলন। মাছ ছাড়া চলে না। আমার কথা আলাদা। কিন্তু দেশবাসীকে মাছ-মাংস না খাওয়ার ফরমান দিতে পারি না। জোর করে মানুষকে নিরামিষ খেতে বাধ্য করতে পারি না। এটা মানুষের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
আরও পড়ুন: Shatrughan Singh: ‘শুধু গোমাংসই নয়, আমিষ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত’, বলছেন তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার বলেন, “ভীষণ অর্থহীন মন্তব্য। এর কোনও মানে হয় না। কিছু মাত্র গুরুত্ব দিলেও এটা ভারতের ঐক্য এবং সংস্কৃতিকে এত বড় আঘাত করে যে এই বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে রাজি নই আমি। আমার মনে হয়, যাঁরা প্রচারের আলোয় থাকতে অভ্যস্ত, আলোর বাইরে চলে গেলে আবার ফিরে আসতে মন চায়। জানেন বিতর্কিত মন্তব্য করলে অনেক দিন চর্চা হবে। তাই এমন কথা বলেছেন। নিরর্থক, অন্যায় এবং অসঙ্গত একটি কথা।”
দলে অন্দরেও শত্রুঘ্নর মতামত নিয়ে ভিন্ন মত ধরা পড়েছে। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “আমাদের নেত্রী বার বার বলেছেন, সব ধর্ম, জাতি, বর্ণকে সমান সম্মান দেওয়ার কথা। কে কী খাবেন, কী পরবেন, তার মধ্যে কেন ঢুকব? প্রত্যেকের স্বাধীনতা রয়েছে। আমি কী খাব, আমি ঠিক করব। আমি কী পরব, আমি ঠিক করব। নিয়ম করে, আইন করে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে কেউ মন্তব্য করলে, তাঁর ব্যক্তিগত মন্তব্য। এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলব না।”
বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হওয়া নিয়ে প্রশ্নের জবাবে দিতে গিয়ে সম্প্রতি বিতর্কিত মন্তব্য করেন শত্রুঘ্ন। সেখানে তিনি বলেন, “উত্তরাখণ্ডে যা হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হওয়া উচিত। কিন্তু এর মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ জড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে একদিন, নির্বাচনের আগে চালু করে দিলেই হল না।” অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সর্বদল বৈঠক হওয়া উচিত, সকলের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে মত তাঁর। (TMC News)
এর পরই আমিষ খাওয়ার প্রসঙ্গে চলে যান শত্রুঘ্ন। বলেন, “অনেক জায়গায় গোমাংস নিষিদ্ধ করেছেন আপনারা (বিজেপি)। সঠিক সিদ্ধান্ত। আমার মতে, গোমাংস কেন আমিষ খাবারই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু কোথাও গোমাংস নিষিদ্ধ, কোথাও নয়। উত্তর-পূর্বে কী হয়েছে! আমার এক বন্ধু বেশ ভাল বলেছেন, ওখানে খেলে ‘ইয়াম্মি’, আর অন্য কোথাও খেলে ‘মাম্মি’? এমন তো চলবে না। নিষিদ্ধ করতে হলে সর্বত্র করা হোক।” আমিষ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত বলে শত্রুঘ্ন যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়রা বরাবর খাদ্যাভ্য়াসের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। এমনকি দিল্লির বিজেপি নেতাদের মুখে যখনই আমিষ-ভোজী বাঙালিদের উদ্দেশে কটাক্ষ উড়ে এসেছে, বাঙালিদের হয়ে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। সেই দলের সাংসদ শত্রুঘ্ন এমন মন্তব্য করলেন কী করে, প্রশ্ন উঠছে স্বভাবতই।
যদিও অনেকে আবার শত্রুঘ্নর রাজনৈতিক অতীত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। বিজেপি থেকে কংগ্রেস হয়ে তৃণমূলে আগমন শত্রুঘ্নর। তাই তাঁর মুখে এমন মন্তব্য স্বাভাবিক বলেও যুক্তি দিচ্ছেন কেউ কেউ। আর এই আবহেই শত্রুঘ্নর মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্য়ায়। তাঁর বক্তব্য, “আমিষ বন্ধ করা নিয়ে উনি যা বলেছেন, তা নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করুন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে শত্রুঘ্ন সিনহার অবস্থানের সঙ্গে একমত কি না, জানান উনি। আমি তো শত্রুঘ্নর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। মাননীয়া বলুন, তিনি এটাকে সমর্থন করেন কি না।”
আরও দেখুন