স্বরূপ দত্ত
পুজোর মরশুম চলছে। তৃতীয়াও হয়ে গেল। দেখতে দেখতে চলে যাবে এবারের পুজোও। কিন্তু মাঝের এই কটা দিন পুজোর উদ্যোক্তাদের অনেক কাজের চাপ। তাঁরা সারা বছর ধরে যা ভেবেছেন, সেগুলোর বাস্তব রূপ দিয়েছেন। আর পুজোর এই চারটে দিন তাঁদের এই সৃষ্টিশীলতা যত বেশি মানুষ দেখে ভালো বলবে, তত ভালো লাগবে তাঁদের। পুজোর উদ্যোক্তাদের। যে প্রশংসা তাঁরা পাবেন, তাঁর সিংহভাগ নেবেন তাঁরা। যে সমালোচনা খানিকটা জুটবে তাঁদের, তা চাপিয়ে দেবেন নিচের সহকর্মীদের, বন্ধুদের ঘাড়ে! (ব্যতিক্রম আছে)।
তাই মনে হল, আজ একটু ক্যাপ্টেনদের নিয়ে লিখি। কী হয় ক্যাপ্টেনরা? কীভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করেন ক্যাপ্টেনরা? সেগুলোই আজ আলোচনা করি অল্প পরিসরে। দেখবেন, আপনার জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। পেতেই হবে। কারণ, আপনি তো আর কোনও এলিয়েন নন যে, আমির খানের পিকের মতো রেডিও সামনে করে এখানে চলে এসেছেন। আপনাকেও আমাদের এই সমাজে বেড়ে উঠতে হয়েছে। আপনার জীবনেও অনেক ক্যাপ্টেন এসেছেন। অথবা আপনি নিজেও অনেকক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন্সি করেছেন। তাই আমার কথাগুলো শুধু পড়বেন না। অনুভব করতে থাকুন। মেলাতে থাকুন। এবার আমি আমার ‘ডায়রেক্ট স্টেটমেন্টে’ চলে যাই। তা হলো, — ‘একজন ব্যর্থ ক্যাপ্টেন শুধু নিজে ব্যর্থ হন না। বরং, তিনি জীবনটা তছনছ করে দেন অনেক মানুষের। অনেক ‘ভালো ক্যাপ্টেন হতে পারা’ মানুষগুলোর জীবন নষ্ট হয়ে যায়, শুধুমাত্র ওই ব্যর্থ ক্যাপ্টেনদের জন্য! কিছুক্ষেত্রে এই ব্যর্থ ক্যাপ্টেনদের জন্য কত মানুষের প্রাণও চলে যায়!’ এই আমার বক্তব্য। এবার এই বক্তব্যের স্বপক্ষে চারটে স্তরের কথা বলি, এক এক করে।
১) আপনি ফিরে যান আপনার স্কুলজীবনে – মনে আছে স্কুলের ক্লাসে আমাদের মনিটর বা ক্যাপ্টেন থাকতো! আমাদের শিক্ষকরা চাইতেন একজন বা দুজন ক্যাপ্টেন ক্লাসরুমের পরিবেশ-পরিস্থিতিটা শান্ত রাখুক শুধু। যাতে গোলমাল না হয়। যাতে ক্লাসের শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আর পাশের ক্লাস করাতে অন্য শিক্ষক মহাশয়ের কোনও অসুবিধা না হয়। কিন্তু সেই ছেলেবেলার ‘অযোগ্য/ব্যর্থ’ ক্যাপ্টেন ভেবে নিত, সে রাজা। সবার নাম লিখে রাখাটাই তার কাজ। শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলেই তাঁকে দিয়ে ওই অপছন্দের বন্ধুদের মার বা বকা খাওয়ানোটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এবং ক্যাপ্টেন্সির মুন্সিয়ানা! এবার ভাবুন, আমাদের সমাজের ওই ছোট ছেলেমেয়েগুলো ছেলেবেলা থেকেই হতে শুরু করল অবিচারের শিকার। মনে তো তার প্রভাব পড়বেই যে, অকারণে এই সমাজে মার বা বকা খেতে হয়। সে তো তখন ছোট। নিজেকে নির্দোষও প্রমাণ করতে পারে না। আমার-আপনার জীবনে সেই ছেলেবেলার দিনগুলোতে যদি ওই অপদার্থ মনিটর বা ক্যাপ্টেনরা না আসতো, তাহলে হয়তো আমাদের মতো কেউ কেউ আরও একটু শিক্ষক সান্নিধ্য পেতাম! ভাববেন। শিশুরা কীভাবে আরেক শিশুর অপদার্থতার শিকার হওয়া শুরু করে ওই অল্প বয়স থেকেই। কেউ বাঁচানোর নেই। আজ আমাদের বাচ্চারাও স্কুলে যায়। কাল আপনার বাচ্চাটিও স্কুলে যাবে। এই অবিচারের শিকার থেকে কেউ ওদের বাঁচানোর নেই। যেমন আমাদের বাঁচানোর কেউ ছিল না।
২) খেলার মাঠের ক্যাপ্টেন – – হাজারটা উদাহরণ। একটা দিই। আপনি তো বাঙালি। বুঝতে সুবিধা হবে। মহম্মদ আজাহারউদ্দিনকে নিয়ে আজ সিনেমা-টিনেমা হচ্ছে। তিনি এখন ধোওয়া তুলসীপাতা। অথচ, এই লোকটাই ১৯৯৬-এর লর্ডসে যখন সক্কাল সক্কাল স্যাঁতস্যাঁতে পিচে ভারতের টপাটপ দু’ উইকেট পড়ে গিয়েছিল, নিজে (নির্ধারিত সময়ে)না ব্যাট করতে নেমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভকে। সহজ সমীকরণ। জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংসে সৌরভ যাবেন। কর্ক, মুলালিদের বলে আউট হয়ে ফিরবেন। আর আজ্জুভাই হাসিমুখে কাঁচি করে দেবেন সৌরভকে। ব্যার্থতার অজুহাত দেখিয়ে! হায় রে আজাহারবাবু! একেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আজ সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন! খেলার মাঠে ক্যাপ্টেনদের অবিচারের শিকার হয়ে কত কত যোগ্য প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের জীবনটাই শেষ হয়ে যায়। কজনই বা খবর রাখি কত প্রতিভা না উঠতে পারার কারণের হিসেবে! জেনে রাখুন। অভাব নয়, এর সিংহভাগ দোষ থাকে ওই ক্যাপ্টেনদের। নিজের লোক। একমাত্র যোগ্যতা, ক্যাপ্টেনের পাশে থাকার। জানি না cv তে এখনও কথাটা লেখার প্রচলন হল না কেন! তবে, খেলার মাঠে ক্যাপ্টেনদের কখনও সখনও ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে শুনি।
৩) এবার আসুন কর্মজীবনের ক্যাপ্টেনদের কথায় — আপনি যে পেশাতেই থাকুন। যদি না আপনি ব্যবসায়ী হন, কম বেশি আপনাকে এই সমস্যায় পড়তেই হয়েছে। আপনি অনেক বেশি যোগ্য হয়ে নিচে থেকে গিয়েছেন। দূরে থেকে গিয়েছেন। অপদার্থ প্রমাণিত হয়েছেন। আর সেই ক্যাপ্টেন দিব্যি সব ব্যর্থতার দায় আপনাদের কাঁধে চাপিয়ে নিজে কলার তুলে ঘুরে বেরিয়েছেন। (ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। কিন্তু আপনি খেয়াল করে দেখবেন, যদি তিনি সফল হন, তাহলে সব ক্রেডিট তাঁর। তখন তাঁর সহকর্মীরা আর সহকর্মীই নন, শুধুই অধঃতন কর্মচারী! ওই কথায় বলে না, – ভাইয়েদের ঘাম আর দাদাদের নাম! সেই অযোগ্য ক্যাপ্টেন মানুষটা যদি তাঁর যোগ্য পদে অযোগ্য হয়ে একটা-দুটো বছরও কাটিয়ে দেন, তাহলেই তো কত মানুষের বুকের আগুনটুকু নিভে যাবে! তাঁরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে যাবে। সমাজ তাঁকে পাগল বলে ডাকবে। আর ‘ব্যাটা ক্যাপ্টেন’ কোনও তিন তলার বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দেবে! আঃ কী জীবন বলে!
৪) এমন খারাপ ক্যাপ্টেন (পদ নয়, উচ্চপদস্থ) যদি জওয়ানদেরও জোটে! — হয়তো নিশ্চয়ই। কারণ, মনে হয় না আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের সমাজের থেকে আলাদা। আমাদের সমাজের নিয়ম কানুনের থেকে অনেক বেশি কড়া, শৃঙ্খলপরায়ণ মানুষ হন তাঁরা। হলেই বা। তাঁদের মধ্যেও তো ল অফ অ্যাভারেজে দু-চারটে খারাপ ক্যাপ্টেন বেরিয়ে যেতে পারে। অথবা, বাইরের ক্যাপ্টেনদের কথাও তো সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনদের শুনতে হয়। উপায় কী, কথা না শুনে? আপনার দেশটাই স্বাধীন শুধু। আপনি এই পৃথিবীতে কোনওদিন স্বাধীন নন। এবার ভাবুন, সেই অযোগ্য ক্যাপ্টেন যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও ভুল নির্দেশ দিলেন। যেমন পরিকল্পনা না নিলেই ভালো হতো হয়তো। খুব স্বাভাবিক ঘটনা। একজন যোগ্য মানুষেরও ভুল হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, কম হবে সংখ্যায়। কিন্তু সংখ্যা বেশিই হোক অথবা কম, ওই ভুল নির্দেশ, পরিকল্পনার জন্য তো কত জওয়ানের প্রাণও চলে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে! এ তো আর ক্রিকেট বা ফুটবলের ব্যর্থতা নয় যে, আপনি শুধু খেলাটা হারবেন। এখানে আপনি জীবনটাই হারাবেন। আমি নিশ্চিত, এরকম ঘটনা এ পৃথিবীতে একটা-দুটো হলেও ঘটে। ল অফ অ্যাভারেজে ঘটলেও ঘটে।
তাই আসি সবশেষে প্রশ্নে। এই অযোগ্য ক্যাপ্টেনদের ইয়ার্কি মারার দিনগুলো কি কোনওদিনও ফুরোবে না? স্কুলজীবনে ওরা অন্য ছাত্রের নরম মনটাকে ভেঙে দেবে। খেলার মাঠে ওরা প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের জীবন নষ্ট করে দেবে। কর্মজীবনে ওরা অনেক দক্ষ সহকর্মীকে পাগল করে দেবে। আর সেনাবাহিনীতে গেলে খুব কমসংখ্যক মানুষের দু-চারটে ভুলে যদি জওয়ানের মৃত্যুও হয়, সে দায় কী এই সমাজের না? ওই অপদার্থ ক্যাপ্টেনদের নয়? মৃত্যু তো কর্মজীবনের হতাশা সহ্য করতে না পেরেও হয়। আসলে ক্যাপ্টেনকে বাছেনও ক্যাপ্টেনরাই। তাই গলদ ওই গোড়াতেই। নিজের লোক চাই। তবু, আজও এই অযোগ্য ক্যাপ্টেনদের হিম্মত হল না এটা বলতে যে, – তোমার cv তে তো কোথাও দেখতে পেলাম না, তুমি আমার লোক হবে?
(লেখাটা ক্যাপ্টেনদের খারাপ দিকটা নিয়ে। কয়েনের উল্টোদিকটাও আছে। ভালো ক্যাপ্টেন কী করতে পারে, সেটা না হয় আর একদিন আলোচনা করব। আপাতত সমাজের সমস্ত ভালো ক্যাপ্টেনদের একটা স্যালুট জানালাম। কারণ, তাঁরা নিজেরা শুধু সফল হন না, সঙ্গের অনেক মানুষকে সফল গড়ে তোলেন। আর এই লেখা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। এটাই ২৪ ঘণ্টা ডট কমের ভাবনা বা মত এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। )