কলকাতা: টানা দু’বার লিগ আইএসএল (ISL 2024-25) লিগ শিল্ড জয়, তার ওপর এ বছর শিল্ডের সঙ্গে কাপ জয়ও। অবসর জীবনে যখন এই সাফল্যের দিনগুলির কথা মনে পড়বে তাঁর, তখন শুধু যে আনন্দ পাবেন, তা নয়, গর্বে বুক ফুলেও যাবে তাঁর। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (Mohun Bagan Super Giant) যে কয়েকজন বাংলার ফুটবলার খেলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র যদি কেউ থেকে থাকেন, তা হলে তিনি অবশ্যই তিনি, শুভাশিস বসু (Subhasish Bose)।
সফল মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের গর্বিত অধিনায়ক তিনি। গতবারেও তাঁর হাতেই উঠেছিল শিল্ড। তবে সে বার জোড়া পালক জুড়তে পারেননি নিজেদের মুকুটে। এ বার সেটাও করে দেখালেন তাঁরা। এর চেয়ে গর্বের আর কীই বা হতে পারে?
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তাঁর ‘জঙ্গলের রাজা’ সংলাপটি এখন প্রায় সব সমর্থকেরই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে তাঁরাই যে সেরা, তা বোঝাতেই শিল্ডজয়ের পর কথাগুলি বলেছিলেন উত্তেজিত ও উচ্ছ্বসিত শুভাশিস। তবে তার পর থেকে তাঁর সেই সংলাপ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে ঠিকই, তবে কথাটা যে ভুল বলেননি, তা তাদের জোড়া খেতাব জয়েই প্রমাণ হয়েছে।
সোজা কথাটা হয়তো সোজা করেই বলার চেষ্টা করেছিলেন সবুজ-মেরুন অধিনায়ক। আসলে তিনি এমনই সরল ও সোজাসুজি। সদ্যসমাপ্ত আইএসএলে যখনই সাংবাদিক-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যখন সমর্থকদের বিপদের সময় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখন সোজাসুজিই কথা বলেছেন।
যেমন মুখে তিনি স্পষ্টবাদী, তেমনই মাঠেও তাঁর স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড আচরণই দলের কাছে বড় প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। প্রতিপক্ষের আক্রমণে কোন খেলোয়াড়টি সবচেয়ে বিপজ্জনক, তা ম্যাচের শুরুতেই বুঝে নেওয়া তাঁর খেলার স্টাইল। বিশেষ করে উইঙ্গারদের সামলানোর গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। যে উইঙ্গার সবচেয়ে ধারালো ও তাঁর দলকে সবচেয়ে বেশি বেগ দেয়, তাঁকেই আটকাতে নিজেকে উজাড় করে দেন এই বঙ্গসন্তান।
দলের নেতৃত্বের দায়িত্বও তিনি পেয়েছেন তাঁর এই সাহসিকতা ও মরিয়া ভাবের জন্যই। গত মরশুম থেকেই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের আর্ম ব্যান্ড তাঁর বাহুতে শোভা পেয়েছে। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। এবং এই দুই মরশুমেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। তাই এ বার শিল্ড ও কাপ জয়ের পর ক্লাব তাঁবুতে তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের কোনও সীমা নেই। সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের পর এমন একজন সফল ও জনপ্রিয় বাঙালি ডিফেন্ডার খুব কমই এসেছেন।
পাঁচ বছর আগে, ২০২০-তে যখন মুম্বই সিটি এফসি থেকে কলকাতায় আসেন, তখন তিনি ছিলেন প্রতিভাবান, কিন্তু এতটা পরিণত ও দায়িত্ববেধসম্পন্ন ছিলেন না শুভাশিস। প্রতিপক্ষের অ্যাটাকারদের আটকানো, তাঁদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণে ওঠা এবং উড়ন্ত বলের দখল নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করা দিয়ে আইএসএল অভিযান শুরু শুভাশিসের। তার পরে ক্রমশ যত সময় এগোয়, ততই দায়িত্ব বাড়ে তাঁর। যখন দলের অধিনায়কত্ব পান তিনি, তখন নিজের খেলায় আরও নিয়ন্ত্রণ আনেন এবং রক্ষণে দায়িত্ব পালন ছাড়াও আক্রমণে উঠে গোল করার ও করানোর চেষ্টাও শুরু করেন শুভাশিস।
তাঁর এই উন্নতি দেখেছেন লক্ষ লক্ষ মোহনবাগান সমর্থকেরাই। যদিও সবটাই নিজেদের চোখে নয়, গত দুই মরশুমে। যখন থেকে সবুজ-মেরুন বাহিনী যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে, নিজেদের ঘরের মাঠে খেলতে শুরু করে। তার আগে তো সবাই ছিল জৈব বলয়ের মধ্যে। সেখানে ফুটবলার, কোচেরা ছাড়া ফ্যানদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। গত দু’বছর ধরে সমর্থকদের সঙ্গ পেয়ে যেন আরও বলিষ্ঠ, দুর্ভেদ্য অথচ নমনীয় হয়ে উঠেছেন বাগান অধিনায়ক। বাংলার উদীয়মান ফুটবলারদের কাছে তাই তিনি এখন এক আদর্শ।
এ মরশুমে লিগ পর্বে নর্থইস্ট ইউনাইটেড, মহমেডান এসসি ও হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে গোল করে বুঝিয়ে দেন, রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক—সব রকম ভূমিকা পালনের জন্যই তিনি তৈরি। প্রথম ছ’টি ম্যাচের মধ্যেই তিনটি গোল করে কোচ মোলিনাকে আশ্বস্ত করেন, তাঁর হাতে শুধু ফরোয়ার্ড-মিডফিল্ডাররাই নেই, গোল করার জন্য আছেন ডিফেন্ডাররাও।
মহমেডানের বিরুদ্ধে ফিরতি লিগে জোড়া গোল করে সমর্থকদের অবাক করে দেন তিনি। সেই ম্যাচে ৪-০ জয়ে তাঁর একার অবদানই ছিল দুই গোলে। মহমেডানের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ৩-০-র জয়ে একটি গোল করা ছাড়াও একটি অ্যাসিস্টও করেছিলেন তিনি। নিজেকে দলের সবচেয়ে কার্যকরী ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন শুভাশিস। তিনি শুধু বাগান-অধিনায়ক নন, সবুজ-মেরুন বাহিনীর সেরা ‘অলরাউন্ডার’-ও। তাঁর এই কার্যকরী ভূমিকাই তাঁকে ভারতীয় দলেও বারবার সুযোগ এনে দিয়েছে। তাঁর দায়িত্ববোধ ভারতীয় দলে তাঁর জায়গাও পাকা করেছে।
২০১৭-য় স্পোর্টিং ক্লুব দ্য গোয়া থেকে বেঙ্গালুরু এফসি-তো যোগ দেন তিনি। বেঙ্গালুরুর দলের হয়ে ৩৪টি ম্যাচ খেলেন। মুম্বই সিটি এফসি-র হয়েও একই সংখ্যক ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। দুই দলেই তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার। কখনও লেফট ব্যাক, কখনও রাইট ব্যাক, এমনকী সেন্টার ব্যাকও। ২০২০-২১ মরশুম শুরুর আগে তিনি ফিরে আসেন তাঁর প্রাক্তন ক্লাব মোহনবাগানে, তখন এটিকে মোহনবাগান। সেই থেকেই জয়যাত্রা চলছে তাঁর।
আইএসএলের নক আউট ফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে ১৪৯ তম ম্যাচ খেলে ফেলেছেন শুভাশিস। সুপার কাপে মাঠে নামলে দেড়শোর মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলবেন। ১১টি গোল করেছেন, ছটি গোল করিয়েছেন। রক্ষণের খতিয়ান তো উঠতিদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। তবে আইএসএলে ১৬৭টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। দশটি গোল ও ছ’টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর।
ম্যাচ: ২৫ | খেলেছেন: ২২২৩ মিনিট | ক্লিন শিট: ১৩ | গোল: ৬ | অ্যাসিস্ট: ১ | নিখুঁত পাস: ৮০% | ইন্টারসেপশন: ৪৮ | ক্লিয়ারেন্স: ৫৮ | ব্লক: ১৭ | সফল ট্যাকল: ৪৪ | সফল পাস: ৯৬৮ | টাচ: ১৭৮৩ | সুযোগ তৈরি: ২০ | ডুয়াল জয়: ১৫২ | এরিয়াল ডুয়াল জয়: ৫৩
তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতা যেখানে এই পর্যায়ের, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যখন প্রশংসার যোগ্য, তখনও কিন্তু কোনও সাফল্যের জন্য নিজের কৃতিত্ব নিতে রাজি নন শুভাশিস। জোড়া খেতাব জয়ের রাতে তিনি বলেন, “এটা আমার একার কৃতিত্ব নয়, গোটা দল নিজেদের সবকিছু দিয়েছে বলেই আমরা ট্রফি জিততে পেরেছি এবং টানা দু’বার শিল্ড জয় করতে পেরেছি। আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হল দলের বন্ধন ও পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া। কোচ খুব ভালভাবে ড্রেসিং রুম সামলেছেন, আমিও চেষ্টা করেছি ড্রেসিংরুমে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখতে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের অবদান, তাদের মনোভাব—মাঠে এবং মাঠের বাইরে—এই সাফল্য অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছে”।
নিজের অনুভূতি নিয়ে তিনি শুধু বলেন, “সতীর্থদের পারফরম্যান্স আর মনোভাব নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টসের অধিনায়ক হিসেবে জেতা আমার জন্য খুবই বিশেষ। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল মোহনবাগানের হয়ে খেলব, আর আজ আমি গর্বিত যে আমি এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি। একই মরশুমে অধিনায়ক হিসেবে শিল্ড এবং কাপ জয় আমার কাছে অত্যন্ত বিশেষ এবং স্মরণীয়”। এমন নিঃস্বার্থ ভাবে যিনি দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তিনিই তো সেরা অধিনায়ক হওয়ার যোগ্য।
(ছবি: আইএসএল মিডিয়া)