কলকাতা: দর্শকদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ওয়েব সিরিজে। বাংলায় এতদিন ফেলুদা, ব্যোমকেশের একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যেই কোনও এক যাদুকাঠিতে দিব্যি নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। ওয়েব সিরিজ থেকে শুরু করে পাড়ি জমিয়েছেন সিনেমার পর্দাতেও। পাঠকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বইয়ের পাতায় হলেও, তাঁকে রক্তমাংসের রূপ দিয়েছেন এক অভিনেতা। তাঁর নামের সঙ্গে যেন জুড়ে গিয়েছে এই চরিত্র। অনেকে এখনও রাস্তাঘাটে তাঁকে ডেকে ফেলেন চরিত্রের নামেই। তিনি অনির্বাণ চক্রবর্তী (Anirban Chakraboty)। আর তাঁর অভিনীত সেই চরিত্রের নাম, অবশ্যই একেনবাবু। সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি ‘একেন: বেনারস ই বিভীষিকা’ উল্লেখযোগ্য ব্যবসা করেছে। ইন্টারনেট বলছে, চলতি বছরে মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে ‘একেন: বেনারস ই বিভীষিকা’। কিন্তু এই একেনের গল্প বলা শুরু হয়েছিল কিভাবে?
২০১৮ সালে প্রথমবার ‘হইচই’-এর ওয়েব প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় একেনবাবু-র সিরিজ। ‘হইচই’-এর কর্ণধার সৌম্য মুখোপাধ্যায় (Soumya Mukherjee) বলছেন, ‘একেনবাবুর সিরিজের শুরু থেকেই লেখক সুজন দাশগুপ্ত আমাদের ভীষণ সাহায্য করেছেন। উনিই একেন চরিত্রটার জন্ম দিয়েছিলেন। তারপরে পদ্মনাভ দাশগুপ্ত সুজনদার সঙ্গে মিলে যেভাবে একের পর এক গল্পগুলো লিখে গিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। ওদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেই আমরা একের পর এক সিরিজ নিয়ে আসি। সেই সময়ে ব্যোমকেশ শুরু করেছি, সাফল্য পেয়েছি। ফেলুদা নিয়ে তখন কথা চলছে। কিন্তু তখন আরেকটা চরিত্র চাইছিলাম, যাকে নিয়ে ফ্রাঞ্জাইজি হিসেবে কাজ করা যেতে পারে। একেনবাবুর চরিত্রটা মনে ধরেছিল কারণ একেন নিজে একজন গোয়েন্দা, সে রহস্য সমাধান করে, কিন্তু সবটাই মজার মোড়কে। আমাদের মনে হয়েছিল দর্শকের কাছে এই বিষয়টা নতুন হবে। এরপরে আমরা অনির্বাণ চক্রবর্তীর মতো অভিনেতাকে পাই যিনি চরিত্রটাকে একেবারে নিজের করে নিয়েছেন। ভারতে তো বটেই, গোটা বিশ্বে আমার অন্তত এমন খুব বেশি উদাহরণ মাথায় আসছে না যে একটা চরিত্র ওয়েব প্ল্যাটফর্মে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তারপরে সিনেমাহলে গিয়ে এত ভালবাসা পেয়েছে। ৮টা সিজন ভীষণ ভাল প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরে আমাদের মনে হয়েছিল, এটা এবার সিনেমায় নিয়ে আসা দরকার।’
প্রথম যখন একেন ওয়েব সিরিজের পর্দায় এল, তখন এই সাফল্যের আঁচ পেয়েছিলেন প্রযোজকেরা? সৌম্য বলছেন, ‘একেবারেই না। প্রথম ৩টে সিজন পর্যন্ত আমরা আন্দাজ পাইনি দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার। মনে হয়েছিল, আরও ভাল চলতে পারে। ফেলুদা, ব্যোমকেশের ইতিমধ্যেই পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু একটা নতুন ফ্রাঞ্জাইজিকে দাঁড় করানো সহজ নয়। ৫-৬ নম্বর সিজন থেকে একেন ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। একেন আমাদের এমন একটা সিরিজ হয়ে যায়, সেটা দেখার জন্য অনেক দর্শক নতুন করে ‘হইচই’ সাবক্রাইব করেছেন। তখন আমাদের মনে হয়, এবার এটা নিয়ে সিনেমা করা দরকার।’
একেন অনির্বাণ চক্রবর্তীর জনপ্রিয়তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই অনির্বাণকে একেন হিসেবে বেছে নেওয়ার শুরুটা কেমন ছিল? সৌম্য বলছেন, ‘ প্রথমেই ভেবেছিলাম, একটা নতুন ফ্রাঞ্জাইজি তৈরি করছে, তাই একেবারে নতুন একজন অভিনেতা চাই। অনির্বাণদা এর আগে থিয়েটারে অনেক কাজ করেছেন, কিন্তু কোনও ফ্রাঞ্জাইজি করেননি। আমরা চেয়েছিলাম এমন একজন অভিনেতাকে, যিনি এসে চরিত্রটা হয়ে উঠবেন। সেই সময় একটা তারকাকে নিতে পারতাম। কিন্তু আমরা যেভাবে একেনবাবুকে ভেবেছিলাম, অনির্বাণদা একেবারে খাপ খেয়ে গিয়েছিলেন। এখন দাঁড়িয়ে মনে হয়, এটা অনির্বাণদা ছাড়া সম্ভবই ছিল না। তবে প্রথম থেকে আমাদের বিশ্বাস ছিল, একেনের জন্য অনির্বাণদার থেকে ভাল আর কেউ হতে পারে না। উনি একেবারে সঠিক কাস্টিং ছিলেন।’
এরপরে একেন-কে কোথায় দেখা যাবে? সিরিজ না সিনেমা? সৌম্য বলছেন, ‘আমরা দুটো নিয়েই কাজ করছি। সিনেমা নিয়ে একটা পরিকল্পনা শুরু ও হয়ে গিয়েছে। একেনকে নিয়ে আরও বড় কিছুই ভাবছি।’ একেন কেন দর্শকদের কাছের হয়ে উঠল বলে মনে করেন সৌম্য? ‘হইচই’-এর কর্ণধার বলছেন, ‘প্রথমত, সুজন দাশগুপ্তের লেখা চরিত্রটার মধ্যেই একটা এমন মজা রয়েছে, সেটা দর্শকের খুব ভাল লেগেছে। দর্শক রহস্য, মজা, খাওয়া দাওয়া, বাঙালিয়ানার এমন মিশেলের স্বাদ বহুদিন পায়নি বলেই আমার মনে হয়। আর একেন ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত। তার সঙ্গে রয়েছে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনা। রসবোধ আর রহস্যের মিশেলে একেনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন জয়দীপদা। জয়দীপদা, অনির্বাণদা, পদ্মনাভদা.. সবাই মিলে একেন-কে নিয়ে এত খেটেছেন, আমার মনে হয় তারই ফল পেয়েছে সবাই।’
অনির্বাণ রাজি না থাকলে, একেন হত? সৌম্য হেসে বললেন, ‘আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা ভাবতেই পারি না। এখন একেন আর অনির্বাণদাকে আলাদা করাই যায় না। তবে এটা বলতে পারেন, আমরা একেন নিয়ে এগিয়েছি কারণ আমরা একটা সঠিক কাস্টিং পেয়েছিলাম। অনেক গল্প নিয়ে তো কাস্টিংয়ের অভাবে কাজ করাই যায় না। একেনের প্রথম সাফল্য লুকিয়ে ওই কাস্টিংয়েই।’