আর্থিক টানাপোড়েনের জের, সপরিবারে চরম সিদ্ধান্ত! ট্যাংরার ঘটনায় ফিরল একাধিক দুর্বিসহ স্মৃতি

সমীরণ পাল, কলকাতা: তদন্ত শুরু হয় পথ দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে। আর তাতেই কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক ঘটনা সামনে চলে এল। ট্যাংরায় একই বাড়ি থেকে পরিবারের তিন মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের জেরে তাঁরা আত্মঘাতী হয়েছেন, না কি খুন করা হয়েছে তাঁদের, সেই নিয়ে মঙ্গলবার থেকে জল্পনা-কল্পনা চলছে। আর এই আবহেই কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এমন একাধিক রোমহর্ষক ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। (Tangra Incident)
ট্যাংরার ঘটনা আসলে খুন, না কি আত্মহত্যা, কে এমন মর্মান্তিক পরিণতি হল পরিবারের সদস্যদের, এমন একাধিক প্রশ্ন উঠছে। প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যার তত্ত্বই উঠে এসেছে এই ঘটনায়। দেশে আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, “এটা একটা রহস্যজনক ঘটমা। আপাতত পরিবাররে লোকজনের কথা মেনে যদি ধরে নিই এটা সুইসাইড প্যাক্ট…অর্থাৎ পরিবারের সব সদস্য মিলে ঠিক করেছি জীবন আর রাখব না। এক্ষেত্রে পরিবাররে প্রত্যেকের কখনওই মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার ইচ্ছে থাকে না। হেড অফ দ্য ফ্যামিলি বাকিদের কনভিন্স করেন, বোঝান কী কারণে জীবন রেখে আর লাভ নেই।” (Kolkata News)
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রথমা চৌধুরী বলেন, “আত্মহত্যার কারণ সবসময় ব্যক্তিগত নয়। ছ’জনই হতাশ ছিলেন? হয়ত প্রচণ্ড কষ্ট, টানাটানি চলছিল। বলতে পারছিলেন না।” আর এই প্রসঙ্গেই শহর কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনার প্রসঙ্গ
আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে টালিগঞ্জে পরিবারের ছয় সদস্যকে বিষ খাইয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন বেকারি ব্যবসায়ী শিবেন্দু সাহা। ২০১২ সালে ম্যুর অ্যাভিনিউয়ে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বাবার ঘরে আগুন লাগিয়ে আত্মঘাতী হন কম্পিউটার ব্যবসায়ী সুপ্রতিম বসু। ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি পাম অ্যাভিনিউয়ের বহুতলে খুন হন একই পরিবারের তিনজন।
১) ২০০৮ সালের ১৮ জুন টালিগঞ্জে বাড়ির ছয় সদস্যকে বিষ খাইয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, বেকারি ব্যবসায়ী, ৩৬ বছর বয়সি শিবেন্দু সাহা। মৃতদেহ দেখে চমকে উঠেছিলেন সকলেই। দেখে মনে হয়েছিল, সকলে যেন ঘুমিয়ে রয়েছেন। শিবেন্দুর স্ত্রী রুমি সাহার সঙ্গে আড়াই মাসের পুত্রসন্তানের দেহ উদ্ধার হয় এক ঘরে। পাশের ঘরে শিবেন্দুর মা এবং তাঁর আড়াই বছরের নাতির দেহ মেলে। অন্য একটি ঘরে দেহ পড়েছিল শিবেন্দুর বাবার মৃতদেহ। যে ঘর থেকে শিবেন্দুর দেহ উদ্ধার হয়, সেখানে তাঁর এক ভাইয়ের দেহও ছিল।
শিবেন্দুর বারমুডার পকেট থেতে যে তিন পাতার সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়, তার ছত্রে ছত্রে ছিল আর্থিক বিপর্যয়ের ফলে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। ওই বাড়িতে এখন পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজু তিওয়ারির কথায়, “ওদের বিষ দিয়ে মেরে দেয়। সুইসাইড করে নিজে। দুই ভাইয়ের মধ্যে কিছু বিবাদ ছিল, টাকা নিয়ে। দুই ভাই মারা যায়নি। এক ভাইয়ের পরিবার মারা গিয়েছে। তদন্ত চলল। ওঁর কাকাও গ্রেফতার হয়েছেন।”
এক সময় সাহা পরিবারের রামকৃষ্ণ বেকারিতে তিন শিফটে ৯০ জন কর্মী নিরাপত্তারক্ষী কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্য়বসা। আর তার পরই চরম সিদ্ধান্ত। পরিবারের সবাইকে মেরে আত্মঘাতী হন বড় ছেলে।
২০১২ সালে ম্যুর অ্যাভিনিউয়েও একই রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। 45E/15A, ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের গঙ্গোত্রী অ্যাপার্টমেন্ট৷ ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার বাসিন্দা ছিলেন সুপ্রতিম বসু৷ পরিবার বলতে কম্পিউটার ব্যবসায়ী সুপ্রতিম, তাঁর স্ত্রী সঙ্গীতা এবং দুই মেয়ে সারণী ও সহেলি৷ সুপ্রতিমবাবুর বাবা সত্তরোর্ধ্ব সুদেশ বসুও এই ফ্ল্যাটেই থাকতেন৷
১৬ জুন গভীর রাতে পাড়া-প্রতিবেশিরা দেখেন বসু পরিবারের ফ্ল্যাটে আগুন জ্বলছে। শাবল দিয়ে ভাঙা হয় সুপ্রতিমের ফ্ল্যাটের দরজা৷ দমকল আসার পর দেখা যায়, ওই ফ্ল্যাটের একটি ঘরের মধ্যেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বসু পরিবারের পাঁচ সদস্যের অগ্নিদগ্ধ দেহ৷
পুলিশের অনুমান ছিল, রাতে সুপ্রতিম ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি হয়৷ অশান্তির জেরেই হয়তো কাঠের মুগুর জাতীয় জিনিস দিয়ে সঙ্গীতার মাথায় আঘাত করেন সুপ্রতিম৷
এর পরেই সঙ্গীতা নিজেদের শোওয়ার ঘর ছেড়ে দুই মেয়ে ও শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে চলে যান৷ সুপ্রতিম সেই ঘরে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন বলে সন্দেহ। শেষ হয়ে যান পরিবারের পাঁচ জনই। পরে পুলিশ জানতে পারে, শহরের ছয়টি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন সুপ্রতিম৷ সেদিনের ঘটনা নিয়ে পরিবারের আত্মীয়রা কেউ মুখ খুলতে চান না।
২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি পাম অ্যাভিনিউয়ের বহুতলে খুন হন একই পরিবারের তিনজন। ঘর থেকে উদ্ধার হয় মা ও যমজ ছেলেদের রক্তাক্ত দেহ। গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধার করা হয় গৃহকর্তা নীল ফনসেকাকে। ঘটনায় উঠে আসে বিবাহ বহিভূত সম্পর্কের পাশাপাশি প্রচুর আর্থিক দেনার বিষয়টি। পরে গৃহকর্তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আরও দেখুন